যৌতুক উপহার নয়, যৌতুক ভিক্ষা: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ

- Update Time : ১০:৫৬:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ১০১ Time View
বিয়ে মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আল্লাহর নির্দেশ এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, _“তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পন্ন কর। আর তোমাদের অধীনস্থ সৎকর্মপরায়ণ দাস-দাসীদেরও। তারা যদি অভাবগ্রস্ত হয়, তবে আল্লাহ তাদের নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত করে দেবেন”_ (সুরা আন-নূর, ২৪:৩২)। এই আয়াত স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, বিবাহ মানব জীবনের স্বাভাবিক ও পবিত্র অংশ এবং এতে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন বা যৌতুকের প্রশ্নই ওঠে না।
যৌতুক: একটি সামাজিক ব্যাধি
যৌতুক বর্তমান সমাজের এক ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচিত। প্রতিদিন অসংখ্য মা-বোন যৌতুকের অভিশাপে নির্যাতিত ও অপমানিত হচ্ছেন। যৌতুকের কারণে তারা শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, এবং অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা নারী জাতিকে যে সম্মান প্রদান করেছেন, তা অন্যান্য ধর্মে অনুপস্থিত। কুরআনে বলা হয়েছে, _“পুরুষেরা নারীদের জন্য দায়িত্বশীল, কেননা আল্লাহ তাদের একের ওপর অন্যের চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের (নারীদের) জন্য ব্যয় করেন”_ (সুরা আন-নিসা, ৪:৩৪)। কিন্তু আজকের সমাজে যৌতুকের মাধ্যমে সেই সম্মানকে পদদলিত করা হচ্ছে।
ইসলামে যৌতুকের অবস্থান
ইসলাম যৌতুককে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে এবং হাদিসে একাধিকবার যৌতুকের বিরুদ্ধে নির্দেশনা পাওয়া যায়। সহিহ বুখারি ও মুসলিমের একাধিক হাদিসে পাওয়া যায়, নবী মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্টভাবে বলেন, _”সর্বাধিক বরকতময় বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যা সবচেয়ে সহজ এবং কম ব্যয়বহুল”_ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫০৯১)। নবী (সা.) এর এই কথা যৌতুকের মতো অবাঞ্ছিত ব্যয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিবাহকে সহজ ও সহজলভ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে যৌতুক গ্রহণকারী
যৌতুক গ্রহণকারীকে ইসলাম জালিম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যৌতুক নেওয়া ইসলামের শিক্ষার বিরোধী। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিসে এসেছে, _”যে ব্যক্তি অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ গ্রহণ করে, সে যেন আগুনের একটি টুকরা গ্রহণ করে”_ (সহিহ মুসলিম)। যারা যৌতুক গ্রহণ করে, তারা শুধু অবৈধ সম্পদই গ্রহণ করে না, তারা নিজেদের জন্য জাহান্নামের পথও বেছে নেয়।
বিয়ে: সামাজিক বন্ধন ও ন্যায়নিষ্ঠতা
ইসলাম বিবাহকে একটি পবিত্র সামাজিক বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করে, যেখানে পুরুষ ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কুরআনে এসেছে, _“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ করো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন”_ (সুরা আর-রূম, ৩০:২১)। এই আয়াত বিবাহের পবিত্রতা এবং প্রেমময় সম্পর্কের উপর আলোকপাত করে, যা যৌতুকের মতো অর্থনৈতিক লেনদেন দ্বারা নষ্ট হওয়া উচিত নয়।
যৌতুকের ফলাফল ও সামাজিক অবক্ষয়
যৌতুকের ফলে সমাজে ব্যাপক নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। শত শত মা-বোন যৌতুকের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বা নানা ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রতিদিনই আমরা পত্রিকা এবং টিভির পর্দায় এই ধরনের নারকীয় ঘটনার সাক্ষী হচ্ছি। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, নারীর প্রতি অন্যায় করা বা তাদের অধিকার হরণ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। নবী (সা.) বলেছেন, _”তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করে”_ (তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৯৫)। অথচ যারা যৌতুকের মাধ্যমে নারীদের অপমান করে, তারা এই উত্তম আচরণের বিপরীত কাজ করে থাকে।
যৌতুক: ইসলামিক ন্যায়বিচারের অবমাননা
ইসলামে নারীদের মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, _“তোমাদের নারীদের সঙ্গে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করো”_ (সুরা আন-নিসা, ৪:১৯)। তবে যারা যৌতুকের মতো প্রথার মাধ্যমে নারীদের কষ্ট দেয়, তারা ইসলামের এই শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায়। যৌতুকের মাধ্যমে তারা নারীর অধিকার হরণ করে এবং তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে।
সমাধান ও পথনির্দেশনা
যৌতুক বন্ধে কেবল আইন প্রয়োগ করাই যথেষ্ট নয়, মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্বের জাগরণ প্রয়োজন। ইসলামিক শিক্ষার আলোকে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যৌতুক গ্রহণ ও প্রদানের চর্চা থেকে নিজেদের বিরত রেখে, প্রকৃত ইসলামিক শিক্ষার চর্চা করলেই কেবল যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
Please Share This Post in Your Social Media

যৌতুক উপহার নয়, যৌতুক ভিক্ষা: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ

বিয়ে মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা আল্লাহর নির্দেশ এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, _“তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পন্ন কর। আর তোমাদের অধীনস্থ সৎকর্মপরায়ণ দাস-দাসীদেরও। তারা যদি অভাবগ্রস্ত হয়, তবে আল্লাহ তাদের নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত করে দেবেন”_ (সুরা আন-নূর, ২৪:৩২)। এই আয়াত স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, বিবাহ মানব জীবনের স্বাভাবিক ও পবিত্র অংশ এবং এতে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন বা যৌতুকের প্রশ্নই ওঠে না।
যৌতুক: একটি সামাজিক ব্যাধি
যৌতুক বর্তমান সমাজের এক ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচিত। প্রতিদিন অসংখ্য মা-বোন যৌতুকের অভিশাপে নির্যাতিত ও অপমানিত হচ্ছেন। যৌতুকের কারণে তারা শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, এবং অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা নারী জাতিকে যে সম্মান প্রদান করেছেন, তা অন্যান্য ধর্মে অনুপস্থিত। কুরআনে বলা হয়েছে, _“পুরুষেরা নারীদের জন্য দায়িত্বশীল, কেননা আল্লাহ তাদের একের ওপর অন্যের চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের (নারীদের) জন্য ব্যয় করেন”_ (সুরা আন-নিসা, ৪:৩৪)। কিন্তু আজকের সমাজে যৌতুকের মাধ্যমে সেই সম্মানকে পদদলিত করা হচ্ছে।
ইসলামে যৌতুকের অবস্থান
ইসলাম যৌতুককে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে এবং হাদিসে একাধিকবার যৌতুকের বিরুদ্ধে নির্দেশনা পাওয়া যায়। সহিহ বুখারি ও মুসলিমের একাধিক হাদিসে পাওয়া যায়, নবী মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্টভাবে বলেন, _”সর্বাধিক বরকতময় বিবাহ হলো সেই বিবাহ, যা সবচেয়ে সহজ এবং কম ব্যয়বহুল”_ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫০৯১)। নবী (সা.) এর এই কথা যৌতুকের মতো অবাঞ্ছিত ব্যয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিবাহকে সহজ ও সহজলভ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে যৌতুক গ্রহণকারী
যৌতুক গ্রহণকারীকে ইসলাম জালিম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যৌতুক নেওয়া ইসলামের শিক্ষার বিরোধী। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিসে এসেছে, _”যে ব্যক্তি অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ গ্রহণ করে, সে যেন আগুনের একটি টুকরা গ্রহণ করে”_ (সহিহ মুসলিম)। যারা যৌতুক গ্রহণ করে, তারা শুধু অবৈধ সম্পদই গ্রহণ করে না, তারা নিজেদের জন্য জাহান্নামের পথও বেছে নেয়।
বিয়ে: সামাজিক বন্ধন ও ন্যায়নিষ্ঠতা
ইসলাম বিবাহকে একটি পবিত্র সামাজিক বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করে, যেখানে পুরুষ ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কুরআনে এসেছে, _“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ করো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন”_ (সুরা আর-রূম, ৩০:২১)। এই আয়াত বিবাহের পবিত্রতা এবং প্রেমময় সম্পর্কের উপর আলোকপাত করে, যা যৌতুকের মতো অর্থনৈতিক লেনদেন দ্বারা নষ্ট হওয়া উচিত নয়।
যৌতুকের ফলাফল ও সামাজিক অবক্ষয়
যৌতুকের ফলে সমাজে ব্যাপক নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। শত শত মা-বোন যৌতুকের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বা নানা ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রতিদিনই আমরা পত্রিকা এবং টিভির পর্দায় এই ধরনের নারকীয় ঘটনার সাক্ষী হচ্ছি। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, নারীর প্রতি অন্যায় করা বা তাদের অধিকার হরণ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। নবী (সা.) বলেছেন, _”তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করে”_ (তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৯৫)। অথচ যারা যৌতুকের মাধ্যমে নারীদের অপমান করে, তারা এই উত্তম আচরণের বিপরীত কাজ করে থাকে।
যৌতুক: ইসলামিক ন্যায়বিচারের অবমাননা
ইসলামে নারীদের মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, _“তোমাদের নারীদের সঙ্গে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করো”_ (সুরা আন-নিসা, ৪:১৯)। তবে যারা যৌতুকের মতো প্রথার মাধ্যমে নারীদের কষ্ট দেয়, তারা ইসলামের এই শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায়। যৌতুকের মাধ্যমে তারা নারীর অধিকার হরণ করে এবং তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে।
সমাধান ও পথনির্দেশনা
যৌতুক বন্ধে কেবল আইন প্রয়োগ করাই যথেষ্ট নয়, মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্বের জাগরণ প্রয়োজন। ইসলামিক শিক্ষার আলোকে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যৌতুক গ্রহণ ও প্রদানের চর্চা থেকে নিজেদের বিরত রেখে, প্রকৃত ইসলামিক শিক্ষার চর্চা করলেই কেবল যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।