পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ঘর দখলের জন্য ইসরায়েলের কৌশল

- Update Time : ১২:৫২:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ২৯৫ Time View

বিবিসি-
ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসবাসরত আয়েশা শাতায়েহ ও তাঁর পরিবার গত ৫০ বছর ধরে নিজ বাড়িতে শান্তিতে বসবাস করছিলেন। তাদের সংসার চলত পশুপালনের মাধ্যমে। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
আয়েশা বিবিসিকে জানান, পশ্চিম তীরে তাঁদের বাড়ির পাশে একটি অবৈধ বসতি স্থাপন চৌকি গড়ে ওঠার পর থেকেই তারা নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই হয়রানি ভয় এবং হুমকির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাড়ি ছাড়ার জন্য তাদেরকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল।
বিবিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অবৈধ চৌকির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গেছে। বর্তমানে পশ্চিম তীরে ১৯৬টি অবৈধ চৌকি আছে, যার মধ্যে ২০২৩ সালেই ২৯টি নতুন চৌকি গড়ে তোলা হয়েছে, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
এ ধরনের চৌকি স্থাপনে ইসরায়েলি সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা অনুমোদন নেই। পশ্চিম তীরে কিছু বৈধ ইহুদি বসতি রয়েছে, যেগুলো সাধারণত শহরাঞ্চলে বড় আকারের স্থাপনা হিসেবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু অবৈধ চৌকিগুলো এমন নয়।
প্রতিটি চৌকি হতে পারে একটি খামার, অনেকগুলো ঘরের সমষ্টি, এমনকি কয়েকটি কাফেলার সমন্বয়ও। বেশিরভাগ সময় এ চৌকির কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকে না। ইসরায়েলের নিজস্ব আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, পশ্চিম তীরে এ ধরনের চৌকি স্থাপন পুরোপুরি বেআইনি।
তবে ইসরায়েল সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে এসব চৌকি স্থাপনে বসতি স্থাপনকারীদের অর্থ ও জমি দিয়ে সহায়তা করে চলেছে। বিবিসি ওয়ার্ল্ডের হাতে আসা বেশ কিছু নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি বন্দোবস্তের তুলনায় অবৈধ চৌকিগুলোর মাধ্যমে দ্রুত বড় জায়গা দখল করা সম্ভব। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়নের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। চৌকিগুলোর প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য নেই, তবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি বিরোধী পর্যবেক্ষক দল পিস নাউ ও কেরিম নাভোটের সংগ্রহ করা চৌকির তালিকা ও স্থান বিবেচনায় এনে বিবিসি বিশ্লেষণ করেছে। এছাড়া, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত একটি গুরুত্বপূর্ণ মত প্রকাশ করে, যেখানে ইসরায়েলকে সব ধরনের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করার এবং ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে, ইসরায়েল এই মতকে মৌলিকভাবে ‘ভুল ও একপক্ষীয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবিসি কৃত্রিম উপগ্রহের ছবির সাহায্যে চৌকিগুলোর অবস্থান ও স্থাপনের সময় বিশ্লেষণ করেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইসরায়েলি সরকারের প্রকাশনা ও সংবাদমাধ্যম থেকে বিভিন্ন চৌকির তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে ১৯৬টি চৌকির মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৮৯টি) গড়ে উঠেছে ২০১৯ সালের পর এবং এই চৌকিগুলোর সাথে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতার সম্পর্ক রয়েছে।
এ বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য আটজন অবৈধ বসতি স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়, যাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও সহিংসতার উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে অন্তত ছয়জন এখনো অবৈধ চৌকি স্থাপন করে বসবাস করছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের ওপর অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের নজিরবিহীন সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং দোষীদের কঠোরভাবে দমন করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
আভি মিজরাহি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার, বলেন, বেশিরভাগ বসতি স্থাপনকারী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইসরায়েলি নাগরিক। তবে, চৌকিগুলোর কারণে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতার পরিমাণ বাড়ছে। তিনি বলেন, “যখনই আপনি ওই এলাকায় অবৈধভাবে চৌকি স্থাপন করবেন, তা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া এক উগ্র ইহুদি বসতি স্থাপনকারী মোশে শারভিট, যিনি আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর চৌকি আয়েশার বাড়ি থেকে ৮০০ মিটার দূরে। মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র মোশে ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনের নির্মিত চৌকির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যা ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা চালানোর ঘাঁটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আয়েশা শাতায়েহ বর্তমানে তাঁর সন্তানকে নিয়ে নাবলুস শহরের কাছে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, “মোশে আমাদের জীবনকে নরকে পরিণত করছেন।” মোশে শারভিট, যিনি আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর অবৈধ চৌকি আয়েশার বাড়ি থেকে ৮০০ মিটার দূরে।
চৌকি নির্মাণের জন্য ইসরায়েলি সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা অনুমোদন নেই। পশ্চিম তীরে কিছু বৈধ ইহুদি বসতি রয়েছে, যা সাধারণত বড় আকারের এবং শহরাঞ্চলে অবস্থিত। এসব বৈধ বসতি অবৈধ চৌকিগুলোর মতো নয়। যদিও উভয় ধরনের বসতি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, আইন অনুযায়ী দখলকৃত এলাকা থেকে বেসামরিক জনগণকে স্থানান্তর করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীরা তাদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক যুক্তি দেখিয়ে এই ভূখণ্ডে থাকার দাবি করেন।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত একটি যুগান্তকারী মত প্রদান করে, যেখানে ইসরায়েলকে সব ধরনের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করার এবং ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে ইসরায়েল এই মতকে মৌলিকভাবে ‘ভুল ও একপক্ষীয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
চৌকিগুলোর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঠেকাতে ইসরায়েল সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং, বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পশ্চিম তীরে চৌকি স্থাপনে অর্থ ও জমি সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি সংস্থা হলো ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউজেডও), যা এক শতকেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে এবং এর বসতি স্থাপনবিষয়ক বিভাগ ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলকৃত এলাকা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত। সংস্থাটি ইসরায়েলের সরকারি তহবিল থেকে অর্থায়ন পেয়ে থাকে এবং এটি ইসরায়েলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।
পিস নাউ নামক সংস্থার সংগ্রহকৃত নথি ও বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে অবৈধ চৌকিগুলোর স্থাপন অব্যাহতভাবে জমি বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউজেডও) এর বসতি স্থাপনবিষয়ক বিভাগ। এই বিভাগের অধীনে জমিগুলোর ব্যবহারের শর্ত ছিল শুধুমাত্র পশুপালন ও খামার হিসেবে ব্যবহার। কিন্তু কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্তত চারটি ক্ষেত্রে এসব জমিতে অবৈধভাবে চৌকি স্থাপন করা হয়েছে।
২০১৮ সালে জেভি বার ইউসেফ নামের এক ব্যক্তি ডব্লিউজেডওর সঙ্গে চুক্তি সই করেন। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগে। ডব্লিউজেডওর বরাদ্দকৃত জমির অবৈধ ব্যবহার সম্পর্কে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি, এবং জেভি বার ইউসেফও কোন উত্তর দেননি।
বিবিসির অন্যান্য নথি থেকে জানা যায়, আমানা নামের একটি সংস্থা পশ্চিম তীরে অবৈধ চৌকি স্থাপনে সহায়তা করতে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। সংস্থাটি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমানার বিরুদ্ধে অবৈধ চৌকি স্থাপনে সহায়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোশে শারভিটের মতো বসতি স্থাপনকারীরা সহিংসতা ও হুমকি দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর অনেক পরিবার ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। গত ১০ মাসে এক হাজারের বেশি হামলা চালানো হয়েছে এবং ৭ অক্টোবরের পর অন্তত ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২৩০ জন। একই সময়ে, ফিলিস্তিনিদের হাতে পাঁচজন বসতি স্থাপনকারী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১৭ জন।
এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল সরকারের মধ্যে নির্মিত চৌকিগুলোর বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত বছর সরকার অন্তত ১০টি চৌকিকে বৈধ বসতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যার মধ্যে ছয়টি ইতিমধ্যে বৈধতা পেয়েছে।
আয়েশা শাতায়েহ জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোশে শারভিট তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন। ২০২১ সালের শেষ দিকে তাঁর বাড়ির পাশে চৌকি স্থাপনের পর থেকেই মোশে তাঁর পরিবারকে নিপীড়ন ও ভয় দেখাতে শুরু করেন। তাঁর স্বামী নাবিল জানান, মোশে তাঁর ছাগলগুলো তাড়িয়ে দিতেন এবং দাবী করতেন, “আমি সরকার, আমি বিচারক, আমি পুলিশ।”
ফিলিস্তিন সরকারের উপনিবেশ ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা কমিশনের প্রধান মোয়াইয়াদ শাবান বলেন, অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা চারণভূমিতে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিয়ে ফিলিস্তিনি কৃষকদের দুরবস্থার মুখে ঠেলে দেন, যার ফলে তারা খাদ্য, পশু চরানো এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত হন।
সূত্রঃ বিবিসি
Please Share This Post in Your Social Media

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ঘর দখলের জন্য ইসরায়েলের কৌশল


বিবিসি-
ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসবাসরত আয়েশা শাতায়েহ ও তাঁর পরিবার গত ৫০ বছর ধরে নিজ বাড়িতে শান্তিতে বসবাস করছিলেন। তাদের সংসার চলত পশুপালনের মাধ্যমে। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
আয়েশা বিবিসিকে জানান, পশ্চিম তীরে তাঁদের বাড়ির পাশে একটি অবৈধ বসতি স্থাপন চৌকি গড়ে ওঠার পর থেকেই তারা নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই হয়রানি ভয় এবং হুমকির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাড়ি ছাড়ার জন্য তাদেরকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল।
বিবিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অবৈধ চৌকির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গেছে। বর্তমানে পশ্চিম তীরে ১৯৬টি অবৈধ চৌকি আছে, যার মধ্যে ২০২৩ সালেই ২৯টি নতুন চৌকি গড়ে তোলা হয়েছে, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
এ ধরনের চৌকি স্থাপনে ইসরায়েলি সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা অনুমোদন নেই। পশ্চিম তীরে কিছু বৈধ ইহুদি বসতি রয়েছে, যেগুলো সাধারণত শহরাঞ্চলে বড় আকারের স্থাপনা হিসেবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু অবৈধ চৌকিগুলো এমন নয়।
প্রতিটি চৌকি হতে পারে একটি খামার, অনেকগুলো ঘরের সমষ্টি, এমনকি কয়েকটি কাফেলার সমন্বয়ও। বেশিরভাগ সময় এ চৌকির কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকে না। ইসরায়েলের নিজস্ব আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, পশ্চিম তীরে এ ধরনের চৌকি স্থাপন পুরোপুরি বেআইনি।
তবে ইসরায়েল সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে এসব চৌকি স্থাপনে বসতি স্থাপনকারীদের অর্থ ও জমি দিয়ে সহায়তা করে চলেছে। বিবিসি ওয়ার্ল্ডের হাতে আসা বেশ কিছু নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি বন্দোবস্তের তুলনায় অবৈধ চৌকিগুলোর মাধ্যমে দ্রুত বড় জায়গা দখল করা সম্ভব। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়নের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। চৌকিগুলোর প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য নেই, তবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি বিরোধী পর্যবেক্ষক দল পিস নাউ ও কেরিম নাভোটের সংগ্রহ করা চৌকির তালিকা ও স্থান বিবেচনায় এনে বিবিসি বিশ্লেষণ করেছে। এছাড়া, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত একটি গুরুত্বপূর্ণ মত প্রকাশ করে, যেখানে ইসরায়েলকে সব ধরনের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করার এবং ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে, ইসরায়েল এই মতকে মৌলিকভাবে ‘ভুল ও একপক্ষীয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবিসি কৃত্রিম উপগ্রহের ছবির সাহায্যে চৌকিগুলোর অবস্থান ও স্থাপনের সময় বিশ্লেষণ করেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইসরায়েলি সরকারের প্রকাশনা ও সংবাদমাধ্যম থেকে বিভিন্ন চৌকির তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে ১৯৬টি চৌকির মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৮৯টি) গড়ে উঠেছে ২০১৯ সালের পর এবং এই চৌকিগুলোর সাথে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতার সম্পর্ক রয়েছে।
এ বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য আটজন অবৈধ বসতি স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়, যাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও সহিংসতার উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে অন্তত ছয়জন এখনো অবৈধ চৌকি স্থাপন করে বসবাস করছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের ওপর অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের নজিরবিহীন সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং দোষীদের কঠোরভাবে দমন করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
আভি মিজরাহি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার, বলেন, বেশিরভাগ বসতি স্থাপনকারী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইসরায়েলি নাগরিক। তবে, চৌকিগুলোর কারণে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতার পরিমাণ বাড়ছে। তিনি বলেন, “যখনই আপনি ওই এলাকায় অবৈধভাবে চৌকি স্থাপন করবেন, তা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া এক উগ্র ইহুদি বসতি স্থাপনকারী মোশে শারভিট, যিনি আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর চৌকি আয়েশার বাড়ি থেকে ৮০০ মিটার দূরে। মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র মোশে ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনের নির্মিত চৌকির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যা ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা চালানোর ঘাঁটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আয়েশা শাতায়েহ বর্তমানে তাঁর সন্তানকে নিয়ে নাবলুস শহরের কাছে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, “মোশে আমাদের জীবনকে নরকে পরিণত করছেন।” মোশে শারভিট, যিনি আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর অবৈধ চৌকি আয়েশার বাড়ি থেকে ৮০০ মিটার দূরে।
চৌকি নির্মাণের জন্য ইসরায়েলি সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা অনুমোদন নেই। পশ্চিম তীরে কিছু বৈধ ইহুদি বসতি রয়েছে, যা সাধারণত বড় আকারের এবং শহরাঞ্চলে অবস্থিত। এসব বৈধ বসতি অবৈধ চৌকিগুলোর মতো নয়। যদিও উভয় ধরনের বসতি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, আইন অনুযায়ী দখলকৃত এলাকা থেকে বেসামরিক জনগণকে স্থানান্তর করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীরা তাদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক যুক্তি দেখিয়ে এই ভূখণ্ডে থাকার দাবি করেন।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত একটি যুগান্তকারী মত প্রদান করে, যেখানে ইসরায়েলকে সব ধরনের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করার এবং ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে ইসরায়েল এই মতকে মৌলিকভাবে ‘ভুল ও একপক্ষীয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
চৌকিগুলোর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঠেকাতে ইসরায়েল সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং, বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পশ্চিম তীরে চৌকি স্থাপনে অর্থ ও জমি সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি সংস্থা হলো ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউজেডও), যা এক শতকেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে এবং এর বসতি স্থাপনবিষয়ক বিভাগ ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলকৃত এলাকা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত। সংস্থাটি ইসরায়েলের সরকারি তহবিল থেকে অর্থায়ন পেয়ে থাকে এবং এটি ইসরায়েলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।
পিস নাউ নামক সংস্থার সংগ্রহকৃত নথি ও বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে অবৈধ চৌকিগুলোর স্থাপন অব্যাহতভাবে জমি বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউজেডও) এর বসতি স্থাপনবিষয়ক বিভাগ। এই বিভাগের অধীনে জমিগুলোর ব্যবহারের শর্ত ছিল শুধুমাত্র পশুপালন ও খামার হিসেবে ব্যবহার। কিন্তু কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্তত চারটি ক্ষেত্রে এসব জমিতে অবৈধভাবে চৌকি স্থাপন করা হয়েছে।
২০১৮ সালে জেভি বার ইউসেফ নামের এক ব্যক্তি ডব্লিউজেডওর সঙ্গে চুক্তি সই করেন। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগে। ডব্লিউজেডওর বরাদ্দকৃত জমির অবৈধ ব্যবহার সম্পর্কে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি, এবং জেভি বার ইউসেফও কোন উত্তর দেননি।
বিবিসির অন্যান্য নথি থেকে জানা যায়, আমানা নামের একটি সংস্থা পশ্চিম তীরে অবৈধ চৌকি স্থাপনে সহায়তা করতে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। সংস্থাটি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমানার বিরুদ্ধে অবৈধ চৌকি স্থাপনে সহায়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোশে শারভিটের মতো বসতি স্থাপনকারীরা সহিংসতা ও হুমকি দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর অনেক পরিবার ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। গত ১০ মাসে এক হাজারের বেশি হামলা চালানো হয়েছে এবং ৭ অক্টোবরের পর অন্তত ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২৩০ জন। একই সময়ে, ফিলিস্তিনিদের হাতে পাঁচজন বসতি স্থাপনকারী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১৭ জন।
এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল সরকারের মধ্যে নির্মিত চৌকিগুলোর বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত বছর সরকার অন্তত ১০টি চৌকিকে বৈধ বসতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যার মধ্যে ছয়টি ইতিমধ্যে বৈধতা পেয়েছে।
আয়েশা শাতায়েহ জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোশে শারভিট তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন। ২০২১ সালের শেষ দিকে তাঁর বাড়ির পাশে চৌকি স্থাপনের পর থেকেই মোশে তাঁর পরিবারকে নিপীড়ন ও ভয় দেখাতে শুরু করেন। তাঁর স্বামী নাবিল জানান, মোশে তাঁর ছাগলগুলো তাড়িয়ে দিতেন এবং দাবী করতেন, “আমি সরকার, আমি বিচারক, আমি পুলিশ।”
ফিলিস্তিন সরকারের উপনিবেশ ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা কমিশনের প্রধান মোয়াইয়াদ শাবান বলেন, অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা চারণভূমিতে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিয়ে ফিলিস্তিনি কৃষকদের দুরবস্থার মুখে ঠেলে দেন, যার ফলে তারা খাদ্য, পশু চরানো এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত হন।
সূত্রঃ বিবিসি