বাংলাদেশের ভূমিকা ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে: সম্পর্ক, প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জ

- Update Time : ০৩:২৬:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৩৮১ Time View

ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূমিকা কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দু’দিন আগে এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ মিয়ানমার থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
এই বক্তব্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে এবং পরবর্তী দিনগুলিতে বিভিন্ন ভারতীয় মিডিয়ায় ইউনূসের বারবার এমন মন্তব্য করেছেন, যেখানে তিনি ভারতের এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দটি ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে চেয়েছেন, যদিও বর্তমানে ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ শব্দগুলোর ব্যবহার ভারতে বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ এবং কৌশলগত সম্পর্কের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থল-সীমান্ত রয়েছে, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এই সেভেন সিস্টার্সের সাথে যুক্ত।
উল্লেখযোগ্য যে, সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম এই চার রাজ্য বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সীমান্ত ভাগ করে। অতীতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকেই তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে এবং যখন বাংলাদেশ সরকার এসব নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে, তখন ওই অঞ্চলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশ আলফা-র নেতাদের হস্তান্তর করেছে বলেই আসাম আজ এত শান্তিপূর্ণ এবং রাজ্যের জনগণ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন। ফলে ভারতের এই অঞ্চলটির ওপর বাংলাদেশের যে কৌশলগত প্রভাব রয়েছে তা অনস্বীকার্য।
তবে ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটির উৎপত্তি এবং এর পিছনে ভারতীয় ইতিহাসের কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ও রয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া ‘নর্থ ইস্টার্ন কাউন্সিল অ্যাক্ট’ এর অধীনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি পরিষদ গঠিত হয়। সেই সময় থেকেই ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
সাংবাদিক জে পি শইকিয়া ১৯৭২ সালে ত্রিপুরার আত্মপ্রকাশের দিনে তার পাঠানো রিপোর্টে প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলে ‘ল্যান্ড অব সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। পরে সেই নামটি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিরও এটি খুব পছন্দ হয়েছিল।
ভারতের পর্যটন বিভাগ থেকে শুরু করে সরকারী কাগজপত্রে এই নামটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে, কিন্তু বর্তমানে ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ কথাটি বেশি প্রচলিত হয়ে উঠেছে, বিশেষত সিকিম যুক্ত হওয়ার পর থেকে।
সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে একটি অত্যন্ত কৌশলগত স্থান, যা ‘শিলিগুড়ি করিডর’ বা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে, কিন্তু এই করিডরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি সবসময় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, এই করিডরের কৌশলগত গুরুত্ব ভারত উপলব্ধি করেছে, তবে সেভেন সিস্টার্সকে ভারতের সাথে আত্মিকভাবে সংযুক্ত করা এখনো সম্ভব হয়নি। শিলিগুড়ি করিডরের পাশে অবস্থিত দার্জিলিং-এর বাসিন্দা এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এই করিডরকে ভারতের জন্য একটি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখতে চান, যেখানে ভারতের ‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’ নীতি এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি মিলিত হয়েছে।
এটি একদিকে ভারতকে আঞ্চলিক সংযোগের সুযোগ দেয়, অন্যদিকে এটি সেভেন সিস্টার্সকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের চেয়ে কিছুটা আলাদা করে রেখেছে।
ভারতের এই অঞ্চলটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলটি সশস্ত্র আন্দোলনে উত্তাল থেকেছে, যা ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
অতীতে এই অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করা বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে, যা উভয় দেশের নিরাপত্তা ও সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র : বিবিসি
Please Share This Post in Your Social Media

বাংলাদেশের ভূমিকা ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে: সম্পর্ক, প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জ


ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূমিকা কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দু’দিন আগে এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ মিয়ানমার থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
এই বক্তব্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে এবং পরবর্তী দিনগুলিতে বিভিন্ন ভারতীয় মিডিয়ায় ইউনূসের বারবার এমন মন্তব্য করেছেন, যেখানে তিনি ভারতের এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দটি ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে চেয়েছেন, যদিও বর্তমানে ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ শব্দগুলোর ব্যবহার ভারতে বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ এবং কৌশলগত সম্পর্কের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থল-সীমান্ত রয়েছে, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এই সেভেন সিস্টার্সের সাথে যুক্ত।
উল্লেখযোগ্য যে, সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম এই চার রাজ্য বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সীমান্ত ভাগ করে। অতীতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকেই তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে এবং যখন বাংলাদেশ সরকার এসব নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে, তখন ওই অঞ্চলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশ আলফা-র নেতাদের হস্তান্তর করেছে বলেই আসাম আজ এত শান্তিপূর্ণ এবং রাজ্যের জনগণ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন। ফলে ভারতের এই অঞ্চলটির ওপর বাংলাদেশের যে কৌশলগত প্রভাব রয়েছে তা অনস্বীকার্য।
তবে ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটির উৎপত্তি এবং এর পিছনে ভারতীয় ইতিহাসের কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ও রয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া ‘নর্থ ইস্টার্ন কাউন্সিল অ্যাক্ট’ এর অধীনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি পরিষদ গঠিত হয়। সেই সময় থেকেই ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
সাংবাদিক জে পি শইকিয়া ১৯৭২ সালে ত্রিপুরার আত্মপ্রকাশের দিনে তার পাঠানো রিপোর্টে প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলে ‘ল্যান্ড অব সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। পরে সেই নামটি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিরও এটি খুব পছন্দ হয়েছিল।
ভারতের পর্যটন বিভাগ থেকে শুরু করে সরকারী কাগজপত্রে এই নামটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে, কিন্তু বর্তমানে ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ কথাটি বেশি প্রচলিত হয়ে উঠেছে, বিশেষত সিকিম যুক্ত হওয়ার পর থেকে।
সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে একটি অত্যন্ত কৌশলগত স্থান, যা ‘শিলিগুড়ি করিডর’ বা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে, কিন্তু এই করিডরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি সবসময় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, এই করিডরের কৌশলগত গুরুত্ব ভারত উপলব্ধি করেছে, তবে সেভেন সিস্টার্সকে ভারতের সাথে আত্মিকভাবে সংযুক্ত করা এখনো সম্ভব হয়নি। শিলিগুড়ি করিডরের পাশে অবস্থিত দার্জিলিং-এর বাসিন্দা এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এই করিডরকে ভারতের জন্য একটি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখতে চান, যেখানে ভারতের ‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’ নীতি এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি মিলিত হয়েছে।
এটি একদিকে ভারতকে আঞ্চলিক সংযোগের সুযোগ দেয়, অন্যদিকে এটি সেভেন সিস্টার্সকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের চেয়ে কিছুটা আলাদা করে রেখেছে।
ভারতের এই অঞ্চলটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলটি সশস্ত্র আন্দোলনে উত্তাল থেকেছে, যা ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
অতীতে এই অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করা বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে, যা উভয় দেশের নিরাপত্তা ও সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র : বিবিসি