সময়: শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

খাবারের লাইনে থাকা শিশুদের হত্যা: ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় রক্তাক্ত গাজা

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০২:১৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
  • / ১২ Time View

1752211895 1422bfbe0cb843105525b98d4b8f6d3b

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

1752211895 1422bfbe0cb843105525b98d4b8f6d3b

পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন কেউ ব্যস্ত ছিল খাওয়ার প্রস্তুতিতে, তখন আরেক প্রান্তে শিশুদের একদল ক্ষুধার্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল খাবারের লাইনে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে জুটল না অন্ন, বরং ড্রোন হামলার নিষ্ঠুর আগুন। গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ এলাকায় একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সামনে পুষ্টিকর খাদ্য সহায়তার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো ড্রোন হামলায় কমপক্ষে ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ছিল আটজন শিশু ও দুইজন নারী। আহতদের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

মৃত্যুর সাক্ষী ক্লিনিক, যেখানে ছিল জীবনের আশ্বাস
আল-আকসা শহীদ হাসপাতাল জানিয়েছে, নিহতদের বেশিরভাগ ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। হাসপাতালের প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে আছে একাধিক শিশুর নিথর দেহ, চারদিকে কান্না ও আর্তনাদের শব্দ, আর চিকিৎসকরা দিশেহারা হয়ে আহতদের জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।

এই ক্লিনিকটি পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন ‘প্রজেক্ট হোপ’। সংস্থাটির মতে, এই হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ঘোরতর লঙ্ঘন এবং এটি একটি সরাসরি যুদ্ধাপরাধ। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রাবিহ তোরবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “গাজার এই ক্লিনিকগুলোই ছিল মানুষের শেষ আশ্রয়। এখন সেখানেই মৃত্যুর হাতছানি। আর কোনো জায়গা নিরাপদ নয়।”

ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাখ্যা ও প্রশ্নবিদ্ধ দাবি
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, তারা হামাসের ‘সন্ত্রাসী সদস্যদের’ লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, টার্গেট ছিল হামাসের অভিজাত ‘নুখবা ইউনিট’-এর এক সদস্য। তবে হামলায় বেসামরিক লোকজনের মৃত্যুতে আইডিএফ দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং বলেছে, তদন্ত চলছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—খাদ্য সহায়তার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুধার্ত শিশু ও নারীরা কি কোনভাবেই ‘টার্গেট’ হতে পারে? মানবিক সহায়তার ক্লিনিকের সামনে ড্রোন হামলার যৌক্তিকতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: রক্তে রাঙা মুহূর্তগুলো
প্রত্যক্ষদর্শী ইউসুফ আল-আইদি বলেন, “হঠাৎ করেই আকাশে ড্রোনের শব্দ, তারপর বিকট বিস্ফোরণ। এক মুহূর্তেই চারপাশ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। শিশুদের চিৎকার, মায়েদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।”

এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, তার গর্ভবতী ভাগ্নি মানাল ও তার ছোট্ট মেয়ে ফাতিমা হামলায় নিহত হয়েছেন। মানালের শিশু ছেলে এখনো আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। পাশে থাকা এক নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “কি অপরাধ ছিল আমাদের? এক টুকরো খাবারের জন্যই কি মরতে হবে?”

জাতিসংঘ ও ইউনিসেফের কড়া প্রতিক্রিয়া
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল এক বিবৃতিতে এই হামলাকে “অযৌক্তিক ও মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতা” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “যেখানে শিশুরা খাবারের আশায় লাইনে দাঁড়ায়, সেখানে তাদের হত্যা কোনো সভ্য জাতির কাজ হতে পারে না।”

জাতিসংঘ জানিয়েছে, চার মাস পর গাজায় সীমিত পরিমাণে জ্বালানি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় একদিনেরও কম। বর্তমানে গাজায় স্বাস্থ্যসেবা, খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের ভয়াবহ সংকট চলছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

একই দিনে আরও একটি হামলা, আরও শিশু নিহত
উল্লেখ্য, একই দিন গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় আল-মাওয়াসি উপকূলীয় এলাকায় আরেকটি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন আরও পাঁচজন, যাদের মধ্যে তিনজনই শিশু। ভিডিওতে দেখা যায়, বালির নিচ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে শিশুদের নিথর দেহ। এসব হামলা গাজার শিশুদের ওপর এক নির্মম গণহত্যার ছবি ফুটিয়ে তুলছে।

যুদ্ধবিরতির আলোচনা: অচল অগ্রগতি
যদিও যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনার কথা চলছে, বাস্তবে কোনো কার্যকর অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, একটি চুক্তি হতে অন্তত এক-দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি চায়—যা ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করবে এবং গাজার জনগণকে নিরাপত্তা দেবে।

শেষ কথা: শিশুদের রক্তে লেখা আরেকটি কালো দিন
এই হামলা শুধু গাজাবাসীর জন্য নয়, মানবতার জন্যই এক গভীর কলঙ্ক। যুদ্ধের নৃশংসতায় যখন শিশুরাও রক্ষা পায় না, তখন প্রশ্ন ওঠে—এটি কাদের যুদ্ধ, কার বিরুদ্ধে? খাদ্যের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের নিথর দেহ আমাদের বিবেককে নাড়া না দিলে, আমরা কেমন সভ্য সমাজে বাস করছি?

সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, প্রজেক্ট হোপ, ইউনিসেফ

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

খাবারের লাইনে থাকা শিশুদের হত্যা: ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় রক্তাক্ত গাজা

Update Time : ০২:১৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

1752211895 1422bfbe0cb843105525b98d4b8f6d3b

পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন কেউ ব্যস্ত ছিল খাওয়ার প্রস্তুতিতে, তখন আরেক প্রান্তে শিশুদের একদল ক্ষুধার্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল খাবারের লাইনে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে জুটল না অন্ন, বরং ড্রোন হামলার নিষ্ঠুর আগুন। গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ এলাকায় একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সামনে পুষ্টিকর খাদ্য সহায়তার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো ড্রোন হামলায় কমপক্ষে ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ছিল আটজন শিশু ও দুইজন নারী। আহতদের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

মৃত্যুর সাক্ষী ক্লিনিক, যেখানে ছিল জীবনের আশ্বাস
আল-আকসা শহীদ হাসপাতাল জানিয়েছে, নিহতদের বেশিরভাগ ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। হাসপাতালের প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে আছে একাধিক শিশুর নিথর দেহ, চারদিকে কান্না ও আর্তনাদের শব্দ, আর চিকিৎসকরা দিশেহারা হয়ে আহতদের জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।

এই ক্লিনিকটি পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন ‘প্রজেক্ট হোপ’। সংস্থাটির মতে, এই হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ঘোরতর লঙ্ঘন এবং এটি একটি সরাসরি যুদ্ধাপরাধ। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রাবিহ তোরবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “গাজার এই ক্লিনিকগুলোই ছিল মানুষের শেষ আশ্রয়। এখন সেখানেই মৃত্যুর হাতছানি। আর কোনো জায়গা নিরাপদ নয়।”

ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাখ্যা ও প্রশ্নবিদ্ধ দাবি
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, তারা হামাসের ‘সন্ত্রাসী সদস্যদের’ লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, টার্গেট ছিল হামাসের অভিজাত ‘নুখবা ইউনিট’-এর এক সদস্য। তবে হামলায় বেসামরিক লোকজনের মৃত্যুতে আইডিএফ দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং বলেছে, তদন্ত চলছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—খাদ্য সহায়তার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুধার্ত শিশু ও নারীরা কি কোনভাবেই ‘টার্গেট’ হতে পারে? মানবিক সহায়তার ক্লিনিকের সামনে ড্রোন হামলার যৌক্তিকতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: রক্তে রাঙা মুহূর্তগুলো
প্রত্যক্ষদর্শী ইউসুফ আল-আইদি বলেন, “হঠাৎ করেই আকাশে ড্রোনের শব্দ, তারপর বিকট বিস্ফোরণ। এক মুহূর্তেই চারপাশ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। শিশুদের চিৎকার, মায়েদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।”

এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, তার গর্ভবতী ভাগ্নি মানাল ও তার ছোট্ট মেয়ে ফাতিমা হামলায় নিহত হয়েছেন। মানালের শিশু ছেলে এখনো আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। পাশে থাকা এক নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “কি অপরাধ ছিল আমাদের? এক টুকরো খাবারের জন্যই কি মরতে হবে?”

জাতিসংঘ ও ইউনিসেফের কড়া প্রতিক্রিয়া
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল এক বিবৃতিতে এই হামলাকে “অযৌক্তিক ও মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতা” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “যেখানে শিশুরা খাবারের আশায় লাইনে দাঁড়ায়, সেখানে তাদের হত্যা কোনো সভ্য জাতির কাজ হতে পারে না।”

জাতিসংঘ জানিয়েছে, চার মাস পর গাজায় সীমিত পরিমাণে জ্বালানি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় একদিনেরও কম। বর্তমানে গাজায় স্বাস্থ্যসেবা, খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের ভয়াবহ সংকট চলছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

একই দিনে আরও একটি হামলা, আরও শিশু নিহত
উল্লেখ্য, একই দিন গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় আল-মাওয়াসি উপকূলীয় এলাকায় আরেকটি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন আরও পাঁচজন, যাদের মধ্যে তিনজনই শিশু। ভিডিওতে দেখা যায়, বালির নিচ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে শিশুদের নিথর দেহ। এসব হামলা গাজার শিশুদের ওপর এক নির্মম গণহত্যার ছবি ফুটিয়ে তুলছে।

যুদ্ধবিরতির আলোচনা: অচল অগ্রগতি
যদিও যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনার কথা চলছে, বাস্তবে কোনো কার্যকর অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, একটি চুক্তি হতে অন্তত এক-দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি চায়—যা ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করবে এবং গাজার জনগণকে নিরাপত্তা দেবে।

শেষ কথা: শিশুদের রক্তে লেখা আরেকটি কালো দিন
এই হামলা শুধু গাজাবাসীর জন্য নয়, মানবতার জন্যই এক গভীর কলঙ্ক। যুদ্ধের নৃশংসতায় যখন শিশুরাও রক্ষা পায় না, তখন প্রশ্ন ওঠে—এটি কাদের যুদ্ধ, কার বিরুদ্ধে? খাদ্যের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের নিথর দেহ আমাদের বিবেককে নাড়া না দিলে, আমরা কেমন সভ্য সমাজে বাস করছি?

সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, প্রজেক্ট হোপ, ইউনিসেফ

শেয়ার করুনঃ
Pin Share