আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বীকারোক্তি দিলেন সাবেক আইজিপি মামুন

- Update Time : ০৬:০৪:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
- / ৩৯ Time View
জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ২০২৫ সালের ১০ জুলাই, বৃহস্পতিবার, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এই মামলায় আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজসাক্ষী হতে চাই।”
তার এই স্বীকারোক্তি দেশের বিচার ও মানবাধিকারের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, এই প্রথমবারের মতো জুলাই-আগস্ট গণহত্যার মতো ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধে একজন উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তার স্বীকারোক্তি প্রকাশ্যে এলো।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন
সাবেক আইজিপি মামুনের এই বক্তব্যের ঠিক আগেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং মামুন নিজেই—এই তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেয়।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে এই আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
মামলার পটভূমি
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে পরিচালিত দমনপীড়নে বহু সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই দমনপীড়নে কয়েক হাজার মানুষ গুম, আটক ও হত্যার শিকার হয়।
২০২৫ সালের ১২ মে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে এই হত্যাযজ্ঞের নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মামুনের ভূমিকা ও স্বীকারোক্তি
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেই সময় পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। তার নেতৃত্বেই পুলিশ বাহিনী মাঠপর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করে। আজকের ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, তিনি শুধু আদেশ পালনকারী নন—বরং তিনি নিজেও গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন,
“আমি আমার বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে এই স্বীকারোক্তি দিচ্ছি। আমি জানি, এর মূল্য দিতে হবে। কিন্তু আমি চাই, ইতিহাস সত্য জানুক এবং যারা প্রকৃত অপরাধী, তারা বিচারের সম্মুখীন হোক।”
তার এই বক্তব্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আইনজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
পরবর্তী কার্যক্রম
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার জানিয়েছেন, মামুনের স্বীকারোক্তি এবং রাজসাক্ষীর আবেদন পর্যালোচনার জন্য একটি বিশেষ শুনানির দিন ধার্য করা হবে। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষকে লিখিত জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে, মামলার অপর দুই আসামি—শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল—তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রয়াস।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সাবেক আইজিপি মামুনের স্বীকারোক্তির পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একদিকে মানবাধিকার কর্মীরা একে “সত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ” হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে সরকারপন্থি মহল একে “রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র” বলে দাবি করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে বিবিসি, আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্সসহ একাধিক গণমাধ্যম মামুনের বক্তব্য ও ট্রাইব্যুনালের আদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে।
এই স্বীকারোক্তি শুধু একটি মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতি, আইন এবং মানবাধিকারের বর্তমান পরিস্থিতিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। জনমনে প্রশ্ন জাগছে—এই বিচারের মাধ্যমে কি সত্যিই ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে? নাকি এটি আরও এক রাজনৈতিক নাটকের সূচনা মাত্র? সময়ই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
Please Share This Post in Your Social Media

আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বীকারোক্তি দিলেন সাবেক আইজিপি মামুন

জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ২০২৫ সালের ১০ জুলাই, বৃহস্পতিবার, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এই মামলায় আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজসাক্ষী হতে চাই।”
তার এই স্বীকারোক্তি দেশের বিচার ও মানবাধিকারের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, এই প্রথমবারের মতো জুলাই-আগস্ট গণহত্যার মতো ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধে একজন উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তার স্বীকারোক্তি প্রকাশ্যে এলো।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন
সাবেক আইজিপি মামুনের এই বক্তব্যের ঠিক আগেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং মামুন নিজেই—এই তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেয়।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে এই আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
মামলার পটভূমি
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে পরিচালিত দমনপীড়নে বহু সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই দমনপীড়নে কয়েক হাজার মানুষ গুম, আটক ও হত্যার শিকার হয়।
২০২৫ সালের ১২ মে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে এই হত্যাযজ্ঞের নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মামুনের ভূমিকা ও স্বীকারোক্তি
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেই সময় পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। তার নেতৃত্বেই পুলিশ বাহিনী মাঠপর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করে। আজকের ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, তিনি শুধু আদেশ পালনকারী নন—বরং তিনি নিজেও গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন,
“আমি আমার বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে এই স্বীকারোক্তি দিচ্ছি। আমি জানি, এর মূল্য দিতে হবে। কিন্তু আমি চাই, ইতিহাস সত্য জানুক এবং যারা প্রকৃত অপরাধী, তারা বিচারের সম্মুখীন হোক।”
তার এই বক্তব্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আইনজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
পরবর্তী কার্যক্রম
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার জানিয়েছেন, মামুনের স্বীকারোক্তি এবং রাজসাক্ষীর আবেদন পর্যালোচনার জন্য একটি বিশেষ শুনানির দিন ধার্য করা হবে। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষকে লিখিত জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে, মামলার অপর দুই আসামি—শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল—তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রয়াস।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সাবেক আইজিপি মামুনের স্বীকারোক্তির পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একদিকে মানবাধিকার কর্মীরা একে “সত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ” হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে সরকারপন্থি মহল একে “রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র” বলে দাবি করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে বিবিসি, আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্সসহ একাধিক গণমাধ্যম মামুনের বক্তব্য ও ট্রাইব্যুনালের আদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে।
এই স্বীকারোক্তি শুধু একটি মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতি, আইন এবং মানবাধিকারের বর্তমান পরিস্থিতিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। জনমনে প্রশ্ন জাগছে—এই বিচারের মাধ্যমে কি সত্যিই ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে? নাকি এটি আরও এক রাজনৈতিক নাটকের সূচনা মাত্র? সময়ই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে।