হঠাৎ কেন হাসিনার তোষামোদি ছেড়ে দিলো ভারতীয় মিডিয়া?,উদ্দেশ্য কী?,একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন

- Update Time : ১০:৪৭:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
- / ৮২ Time View
গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ-ভারত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস মিলছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুণকীর্তনে মত্ত থাকা ভারতীয় মূলধারার কিছু মিডিয়া হঠাৎ করেই তাদের সুর বদলেছে। একসময় ‘অপরিহার্য নেত্রী’, ‘উন্নয়নের রূপকার’, ‘দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক’ বলে যাকে তুলে ধরা হতো, সেই হাসিনার নামের আগে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে “পলাতক প্রধানমন্ত্রী” অভিধা। বিশেষ করে রিপাবলিক বাংলা, টাইমস নাও, জি নিউজ, এবিপি আনন্দের মতো মিডিয়াগুলোর এমন আচরণ বদল চোখে পড়ার মতো।
তবে প্রশ্ন উঠছে হঠাৎ এই ৩৬০ ডিগ্রি ইউটার্ন কেন? এর পেছনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল বা স্বার্থের জায়গাগুলো কী? এই প্রতিবেদন সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে।
১. হাসিনার পুনরাবির্ভাব অসম্ভব, ভারতও বুঝে গেছে
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতীয় নীতিনির্ধারক মহল এবং তাদের প্রভাবিত মিডিয়াগুলো এখন বুঝে ফেলেছে যে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাব প্রায় অসম্ভব। ২০২৪-এর “গণঅভ্যুত্থান” পরবর্তী সময়ে গণহত্যার দায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দমননীতির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার ভাবমূর্তি চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশজ রাজনৈতিক ব্যবস্থাও রূপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন ধারায়।
হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তার ফেরার পথও রুদ্ধ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় মিডিয়াগুলোর আর হাসিনার পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে লাভ নেই বলে তারা উপলব্ধি করেছে।
২. নির্বাচনী কৌশল ও সীমান্ত রাজনীতির পুনর্বিন্যাস
ভারতেও জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এখন চাইছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে—বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বাংলাদেশের নতুন সরকার নিজস্ব নীতিতে চলার সংকেত দিচ্ছে এবং ভারতের একতরফা হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার নীতি গ্রহণ করছে।
এই পরিবর্তন ভারতীয় জনমতের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। বিজেপি-ঘনিষ্ঠ মিডিয়াগুলো তাই হাসিনাকে নিয়ে উল্টো সুরে কথা বলছে, যাতে তারা ভারতের জনগণের সামনে নিজেদেরকে ‘সঠিক অবস্থানে’ থাকার প্রমাণ দিতে পারে।
৩. হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং ভারতীয় অস্বস্তি
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে জানা গেছে। এই তথ্যও ভারতীয় মিডিয়ার দিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা এখন হয়তো বুঝতে পারছে, একজন পলাতক নেত্রীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারতীয় কূটনীতি আন্তর্জাতিকভাবে আর টেকসই নয়। আর যদি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কোনো ট্রাইব্যুনালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচার হয়, সেক্ষেত্রে হাসিনার পক্ষে অতীত সমর্থন ভারতকেই বিপদে ফেলতে পারে।
৪. বাংলাদেশের পর্যটকদের বিরাগ ও ভারতের ব্যবসায়িক ক্ষতি
বাংলাদেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশ প্রতিবছর ভারতে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও কেনাকাটার উদ্দেশ্যে যায়। গণঅভ্যুত্থানের পরপর ভারতীয় মিডিয়াগুলোর বাংলাদেশ-বিরোধী ও হাসিনা-পন্থী প্রচারণা বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মনে গভীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অনেকেই ভারত ভ্রমণ বর্জন করতে শুরু করেন, যার ফলে ভারতীয় পর্যটন, স্বাস্থ্য ও খুচরা বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ক্ষোভ ও ক্ষতির চাপে পড়ে ভারতের কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরাসরি মিডিয়া হাউসগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আর্থিক চাপও ভারতীয় মিডিয়াকে হাসিনার পক্ষে থাকা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করেছে।
৫. আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থান ও ভারতীয় মিডিয়ার ক্ষীণ স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো শেখ হাসিনার সরকারের দমননীতি, নির্বাচনী অনিয়ম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়। ভারত ছিল একমাত্র দেশ যারা এসব ইস্যু উপেক্ষা করে হাসিনার পক্ষে ছিল। তবে যখন আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার ‘পলাতক’ পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন ভারতীয় মিডিয়াগুলোর আগের অবস্থান রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে।
এখন তারা নিজেদের কিছুটা নিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। ফলে হাসিনার নামে আগের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘পলাতক’ বলা হচ্ছে, তাঁর সরকারকে আর “উন্নয়নের রোল মডেল” হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না।
ভারতীয় মিডিয়ার সুর বদল — কৌশলগত না মূল্যবোধগত?
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতীয় মিডিয়ার আচরণে আদর্শ বা নৈতিকতা নয়, বরং কৌশল ও সুবিধার হিসাবই মুখ্য। যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন এবং ভারতীয় স্বার্থরক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছিলেন, তখন তাকে প্রশংসায় ভাসানো হয়েছে। এখন তিনি রাজনৈতিকভাবে পরাজিত, বিতাড়িত ও পলাতক—তাই সেই একই মিডিয়াগুলো এখন তার সমালোচনায় সোচ্চার।
এটি কেবলমাত্র হাসিনা নয়—ভারতের মিডিয়া ও রাষ্ট্রীয় নীতির প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরছে। যেখানে কোনো আদর্শ নয়, কার্যকর স্বার্থরক্ষা ও প্রতিবেশী নিয়ন্ত্রণই মুখ্য নীতি।
এই সুরবদল বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের জন্য এক সতর্কবার্তা—যদি আপনারা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যান, আপনাদের সঙ্গেও একই আচরণ করবে এই ‘গোদি মিডিয়া’।
সুত্রঃইনকিলাব
Please Share This Post in Your Social Media

হঠাৎ কেন হাসিনার তোষামোদি ছেড়ে দিলো ভারতীয় মিডিয়া?,উদ্দেশ্য কী?,একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন

গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ-ভারত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস মিলছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুণকীর্তনে মত্ত থাকা ভারতীয় মূলধারার কিছু মিডিয়া হঠাৎ করেই তাদের সুর বদলেছে। একসময় ‘অপরিহার্য নেত্রী’, ‘উন্নয়নের রূপকার’, ‘দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক’ বলে যাকে তুলে ধরা হতো, সেই হাসিনার নামের আগে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে “পলাতক প্রধানমন্ত্রী” অভিধা। বিশেষ করে রিপাবলিক বাংলা, টাইমস নাও, জি নিউজ, এবিপি আনন্দের মতো মিডিয়াগুলোর এমন আচরণ বদল চোখে পড়ার মতো।
তবে প্রশ্ন উঠছে হঠাৎ এই ৩৬০ ডিগ্রি ইউটার্ন কেন? এর পেছনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল বা স্বার্থের জায়গাগুলো কী? এই প্রতিবেদন সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে।
১. হাসিনার পুনরাবির্ভাব অসম্ভব, ভারতও বুঝে গেছে
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতীয় নীতিনির্ধারক মহল এবং তাদের প্রভাবিত মিডিয়াগুলো এখন বুঝে ফেলেছে যে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাব প্রায় অসম্ভব। ২০২৪-এর “গণঅভ্যুত্থান” পরবর্তী সময়ে গণহত্যার দায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দমননীতির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার ভাবমূর্তি চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশজ রাজনৈতিক ব্যবস্থাও রূপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন ধারায়।
হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তার ফেরার পথও রুদ্ধ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় মিডিয়াগুলোর আর হাসিনার পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে লাভ নেই বলে তারা উপলব্ধি করেছে।
২. নির্বাচনী কৌশল ও সীমান্ত রাজনীতির পুনর্বিন্যাস
ভারতেও জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এখন চাইছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে—বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বাংলাদেশের নতুন সরকার নিজস্ব নীতিতে চলার সংকেত দিচ্ছে এবং ভারতের একতরফা হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার নীতি গ্রহণ করছে।
এই পরিবর্তন ভারতীয় জনমতের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। বিজেপি-ঘনিষ্ঠ মিডিয়াগুলো তাই হাসিনাকে নিয়ে উল্টো সুরে কথা বলছে, যাতে তারা ভারতের জনগণের সামনে নিজেদেরকে ‘সঠিক অবস্থানে’ থাকার প্রমাণ দিতে পারে।
৩. হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং ভারতীয় অস্বস্তি
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে জানা গেছে। এই তথ্যও ভারতীয় মিডিয়ার দিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা এখন হয়তো বুঝতে পারছে, একজন পলাতক নেত্রীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারতীয় কূটনীতি আন্তর্জাতিকভাবে আর টেকসই নয়। আর যদি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কোনো ট্রাইব্যুনালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচার হয়, সেক্ষেত্রে হাসিনার পক্ষে অতীত সমর্থন ভারতকেই বিপদে ফেলতে পারে।
৪. বাংলাদেশের পর্যটকদের বিরাগ ও ভারতের ব্যবসায়িক ক্ষতি
বাংলাদেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশ প্রতিবছর ভারতে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও কেনাকাটার উদ্দেশ্যে যায়। গণঅভ্যুত্থানের পরপর ভারতীয় মিডিয়াগুলোর বাংলাদেশ-বিরোধী ও হাসিনা-পন্থী প্রচারণা বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মনে গভীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অনেকেই ভারত ভ্রমণ বর্জন করতে শুরু করেন, যার ফলে ভারতীয় পর্যটন, স্বাস্থ্য ও খুচরা বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ক্ষোভ ও ক্ষতির চাপে পড়ে ভারতের কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরাসরি মিডিয়া হাউসগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আর্থিক চাপও ভারতীয় মিডিয়াকে হাসিনার পক্ষে থাকা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করেছে।
৫. আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থান ও ভারতীয় মিডিয়ার ক্ষীণ স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো শেখ হাসিনার সরকারের দমননীতি, নির্বাচনী অনিয়ম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়। ভারত ছিল একমাত্র দেশ যারা এসব ইস্যু উপেক্ষা করে হাসিনার পক্ষে ছিল। তবে যখন আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার ‘পলাতক’ পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন ভারতীয় মিডিয়াগুলোর আগের অবস্থান রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে।
এখন তারা নিজেদের কিছুটা নিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। ফলে হাসিনার নামে আগের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘পলাতক’ বলা হচ্ছে, তাঁর সরকারকে আর “উন্নয়নের রোল মডেল” হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না।
ভারতীয় মিডিয়ার সুর বদল — কৌশলগত না মূল্যবোধগত?
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতীয় মিডিয়ার আচরণে আদর্শ বা নৈতিকতা নয়, বরং কৌশল ও সুবিধার হিসাবই মুখ্য। যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন এবং ভারতীয় স্বার্থরক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছিলেন, তখন তাকে প্রশংসায় ভাসানো হয়েছে। এখন তিনি রাজনৈতিকভাবে পরাজিত, বিতাড়িত ও পলাতক—তাই সেই একই মিডিয়াগুলো এখন তার সমালোচনায় সোচ্চার।
এটি কেবলমাত্র হাসিনা নয়—ভারতের মিডিয়া ও রাষ্ট্রীয় নীতির প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরছে। যেখানে কোনো আদর্শ নয়, কার্যকর স্বার্থরক্ষা ও প্রতিবেশী নিয়ন্ত্রণই মুখ্য নীতি।
এই সুরবদল বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের জন্য এক সতর্কবার্তা—যদি আপনারা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যান, আপনাদের সঙ্গেও একই আচরণ করবে এই ‘গোদি মিডিয়া’।
সুত্রঃইনকিলাব