সময়: রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
5
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

মহররমের রোজা কয় তারিখে রাখা উত্তম? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশদ আলোচনা

বিল্লাল হোসেন
  • Update Time : ০৬:১৪:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
  • / ১৩৬ Time View

ASHURA

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

ASHURA

ইসলামের দৃষ্টিতে মহররম মাস একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। এটি হিজরি বর্ষের প্রথম মাস, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা, আত্মত্যাগ, শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ। বর্তমান সময় ১৪৪৭ হিজরি সনের ৩ মহররম। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—মহররমের রোজা কবে রাখা উত্তম?

এই বিষয়ে কুরআন ও সহিহ হাদীসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও শিক্ষার সন্ধান পাই।

মহররম: একটি সম্মানিত মাস

আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বলেন:

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধানে মাস বারোটি, যখন থেকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।”
(সূরা তাওবা: ৩৬)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেন:

আসমানজমিন সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সময় তার মতো চলছে। বছরে ১২ মাস, তার মধ্যে চারটি সম্মানিত: ধারাবাহিকভাবে তিনটি জিলকদ, জিলহজ মহররম; চতুর্থটি হলো রজব।
(সহিহ বুখারি: ৩১৯৭)

আশুরার

রোজার ইতিহাস তাৎপর্য

রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনায় গিয়ে দেখতে পান, সেখানকার ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখে (আশুরা) রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ কী?

তারা জবাব দিলো:

“এই দিনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার কওমকে ফিরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রাখতেন, তাই আমরাও রাখি।”

এ জবাব শুনে রাসূল (সা.) বললেন:

মুসা (.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে বেশি হকদার।
অতঃপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদেরও তা রাখতে নির্দেশ দেন।
(সহিহ বুখারি: ৩৩৯৭)

ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়াতে অতিরিক্ত রোজা

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে:

নবীজি (সা.) যখন আশুরার রোজা পালন করলেন এবং সাহাবিদের তা রাখতে বললেন, তখন সাহাবিরা বললেন, “ইহুদিরাও তো এই দিন রোজা রাখে।”
নবীজি (সা.) বললেন,
পরবর্তী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা শুধু ১০ নয়, বরং এবং ১০ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখব।
(সহিহ মুসলিম: ১১৩৪)

অন্য হাদীসে এসেছে:

তোমরা আশুরার রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য ১০ তারিখের আগে অথবা পরে আরও একদিন রোজা রেখো।
(মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)

মহররমে রোজা রাখার ফজিলত

মহররম মাসের রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদীসে এসেছে:

রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর সম্মানিত মাস (মহররম)-এর রোজা।
(সহিহ মুসলিম: ১১৬৩)

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, রমজানের পর রোজার জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো মহররম মাস।

কয় তারিখে রোজা রাখা উত্তম?

উপরোক্ত হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, আশুরার রোজা (মহররমের ১০ তারিখ) শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য রাসূল (সা.) আমাদের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

তাই রোজার সুনিয়ম হলো:

  • ১০ মহররম
  • অথবা ১০ ১১ মহররম
  • কেউ চাইলে , ১০ ১১এই তিন দিনই রোজা রাখতে পারেন

এভাবে রোজা রাখলে রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহর অনুসরণ হবে এবং ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিল থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে।

মহররম মাসের রোজা শুধুমাত্র অতীত ইতিহাসের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, বরং তা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। এ রোজা মুসা (আ.)–এর অনুসরণ, ফারাওনের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যের স্বীকৃতি এবং রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহ পালনের প্রতীক।

আমরা যদি ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখি, তাহলে আমরা কেবল ইবাদতই করব না, বরং ইসলামের ঐতিহ্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করব।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মহররমের বরকতময় সময় সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নেক আমলের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
5 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
About Author Information

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন, একজন প্রজ্ঞাবান পেশাজীবী, যিনি গণিতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। তার আর্থিক খাতে যাত্রা তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকিং Inc. এবং ব্যাংক-আল-বিলাদে বিদেশী সম্পর্ক ও করেসপন্ডেন্ট মেইন্টেনেন্স অফিসার হিসেবে। প্রথাগত অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে, বিল্লাল একজন প্রখ্যাত লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে মননশীল কলাম ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। তার দক্ষতা বিস্তৃত বিষয় জুড়ে রয়েছে, যেমন অর্থনীতির জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, রেমিটেন্স, রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত দিক। বিল্লাল তার লেখায় একটি অনন্য বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে একত্রিত করে একাডেমিক কঠোরতার সাথে। তার প্রবন্ধগুলো শুধুমাত্র জটিল বিষয়গুলির উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন নয়, বরং পাঠকদের জন্য জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। বিল্লাল হোসেনের অবদান তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে, তিনি আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জটিলতাগুলি উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিস্তৃত এবং আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার দিকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
5
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

মহররমের রোজা কয় তারিখে রাখা উত্তম? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশদ আলোচনা

Update Time : ০৬:১৪:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

ASHURA

ইসলামের দৃষ্টিতে মহররম মাস একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। এটি হিজরি বর্ষের প্রথম মাস, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা, আত্মত্যাগ, শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ। বর্তমান সময় ১৪৪৭ হিজরি সনের ৩ মহররম। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—মহররমের রোজা কবে রাখা উত্তম?

এই বিষয়ে কুরআন ও সহিহ হাদীসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও শিক্ষার সন্ধান পাই।

মহররম: একটি সম্মানিত মাস

আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বলেন:

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধানে মাস বারোটি, যখন থেকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।”
(সূরা তাওবা: ৩৬)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেন:

আসমানজমিন সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সময় তার মতো চলছে। বছরে ১২ মাস, তার মধ্যে চারটি সম্মানিত: ধারাবাহিকভাবে তিনটি জিলকদ, জিলহজ মহররম; চতুর্থটি হলো রজব।
(সহিহ বুখারি: ৩১৯৭)

আশুরার

রোজার ইতিহাস তাৎপর্য

রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনায় গিয়ে দেখতে পান, সেখানকার ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখে (আশুরা) রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ কী?

তারা জবাব দিলো:

“এই দিনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার কওমকে ফিরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রাখতেন, তাই আমরাও রাখি।”

এ জবাব শুনে রাসূল (সা.) বললেন:

মুসা (.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে বেশি হকদার।
অতঃপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদেরও তা রাখতে নির্দেশ দেন।
(সহিহ বুখারি: ৩৩৯৭)

ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়াতে অতিরিক্ত রোজা

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে:

নবীজি (সা.) যখন আশুরার রোজা পালন করলেন এবং সাহাবিদের তা রাখতে বললেন, তখন সাহাবিরা বললেন, “ইহুদিরাও তো এই দিন রোজা রাখে।”
নবীজি (সা.) বললেন,
পরবর্তী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা শুধু ১০ নয়, বরং এবং ১০ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখব।
(সহিহ মুসলিম: ১১৩৪)

অন্য হাদীসে এসেছে:

তোমরা আশুরার রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য ১০ তারিখের আগে অথবা পরে আরও একদিন রোজা রেখো।
(মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)

মহররমে রোজা রাখার ফজিলত

মহররম মাসের রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদীসে এসেছে:

রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর সম্মানিত মাস (মহররম)-এর রোজা।
(সহিহ মুসলিম: ১১৬৩)

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, রমজানের পর রোজার জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো মহররম মাস।

কয় তারিখে রোজা রাখা উত্তম?

উপরোক্ত হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, আশুরার রোজা (মহররমের ১০ তারিখ) শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য রাসূল (সা.) আমাদের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

তাই রোজার সুনিয়ম হলো:

  • ১০ মহররম
  • অথবা ১০ ১১ মহররম
  • কেউ চাইলে , ১০ ১১এই তিন দিনই রোজা রাখতে পারেন

এভাবে রোজা রাখলে রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহর অনুসরণ হবে এবং ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিল থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে।

মহররম মাসের রোজা শুধুমাত্র অতীত ইতিহাসের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, বরং তা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। এ রোজা মুসা (আ.)–এর অনুসরণ, ফারাওনের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যের স্বীকৃতি এবং রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহ পালনের প্রতীক।

আমরা যদি ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখি, তাহলে আমরা কেবল ইবাদতই করব না, বরং ইসলামের ঐতিহ্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করব।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মহররমের বরকতময় সময় সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নেক আমলের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share