এনবিআরে অচলাবস্থায় দৈনিক আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি: বিপর্যয়ের মুখে দেশের বাণিজ্য

- Update Time : ০৬:২৮:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
- / ১০৭ Time View

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার কোটি থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ক্রয়াদেশ বাতিলের হুমকি, যা দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প খাত—বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য চরম সংকট ডেকে আনতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার (২৯ জুন) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে অংশ নেয় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিসিআই, আইসিসি বাংলাদেশ সহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সংগঠন।
অচলাবস্থার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরলেন ব্যবসায়ীরা
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অচলাবস্থার কারণে দেশ প্রতিদিন গড়ে ২,৫০০ থেকে ২,৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্যিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়া থমকে গেছে। ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলো টিকে থাকার সংগ্রামে রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অনেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।”
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার–উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, “বন্দর ও বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকছে। পণ্য খালাস না হওয়ায় বৃষ্টি, রোদে অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে শুধু ব্যবসায়ী নয়, ভোক্তা পর্যায়েও পণ্যের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রতি হস্তক্ষেপের আহ্বান
সব সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এনবিআরের কর্মকর্তাদের চলমান কর্মবিরতি ও শাটডাউনের কারণে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, শুল্ক ফাঁকি প্রতিরোধ, ভ্যাট আদায় ও আয়কর সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা থেমে যেতে বসেছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণে ব্যবসায়ী নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে দ্রুত কার্যকর হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এখন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক অবস্থান নয়—দরকার একটি বাস্তবসম্মত ও দ্রুত সমাধান, যাতে ব্যবসা বাণিজ্য আবার সচল হয়।
সমস্যা সমাধানে আলোচনার ওপর জোর
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি—কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনার বাইরে হতে পারে না। বসতে হবে, শুনতে হবে, কিছু ছাড় দিতে হবে। তবে এটাও সত্য, এনবিআরের কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার মানেই কিন্তু দমন-পীড়ন নয়। এটা হতে হবে সম্মানজনক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা দেখতে চাই, সরকার ও আন্দোলনরত কর্মকর্তারা উভয় পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করেন এবং দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেন।”
আন্দোলন প্রত্যাহারে অনুরোধ, কিন্তু এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণে আপত্তি
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, যেন তারা শর্তহীনভাবে কাজে ফিরে যান এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ‘এখন আর দোষারোপের সময় নয়, এখন সমাধানের সময়।’
তবে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের কথা বললেও, তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণের পক্ষে নয়। তাদের মতে, ব্যক্তি পরিবর্তন নয়, দরকার কাঠামোগত সমাধান।
সংকট দীর্ঘায়িত হলে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে যদি অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হয়, তবে কেবল আমদানি-রপ্তানি নয়, শিল্প, কৃষি, ভোক্তা বাজার—সব কিছুতেই ধস নামবে। ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চরম চাপের মুখে পড়েছে।
সরকার, এনবিআর এবং আন্দোলনরত কর্মকর্তা—সবার দায়িত্ব এখন একটাই হওয়া উচিত: দ্রুততম সময়ে সমাধান বের করা। নয়তো, আড়াই হাজার কোটি টাকার এই দৈনিক ক্ষতি আর কেবল ব্যবসায়ীদের বিষয় থাকবে না—এটি হয়ে উঠবে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সম্ভাবনার সবচেয়ে বড় বাধা।
Please Share This Post in Your Social Media

এনবিআরে অচলাবস্থায় দৈনিক আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি: বিপর্যয়ের মুখে দেশের বাণিজ্য


জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার কোটি থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ক্রয়াদেশ বাতিলের হুমকি, যা দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প খাত—বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য চরম সংকট ডেকে আনতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার (২৯ জুন) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে অংশ নেয় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিসিআই, আইসিসি বাংলাদেশ সহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সংগঠন।
অচলাবস্থার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরলেন ব্যবসায়ীরা
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অচলাবস্থার কারণে দেশ প্রতিদিন গড়ে ২,৫০০ থেকে ২,৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্যিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়া থমকে গেছে। ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলো টিকে থাকার সংগ্রামে রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অনেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।”
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার–উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, “বন্দর ও বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকছে। পণ্য খালাস না হওয়ায় বৃষ্টি, রোদে অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে শুধু ব্যবসায়ী নয়, ভোক্তা পর্যায়েও পণ্যের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রতি হস্তক্ষেপের আহ্বান
সব সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এনবিআরের কর্মকর্তাদের চলমান কর্মবিরতি ও শাটডাউনের কারণে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, শুল্ক ফাঁকি প্রতিরোধ, ভ্যাট আদায় ও আয়কর সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা থেমে যেতে বসেছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণে ব্যবসায়ী নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে দ্রুত কার্যকর হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এখন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক অবস্থান নয়—দরকার একটি বাস্তবসম্মত ও দ্রুত সমাধান, যাতে ব্যবসা বাণিজ্য আবার সচল হয়।
সমস্যা সমাধানে আলোচনার ওপর জোর
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি—কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনার বাইরে হতে পারে না। বসতে হবে, শুনতে হবে, কিছু ছাড় দিতে হবে। তবে এটাও সত্য, এনবিআরের কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার মানেই কিন্তু দমন-পীড়ন নয়। এটা হতে হবে সম্মানজনক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা দেখতে চাই, সরকার ও আন্দোলনরত কর্মকর্তারা উভয় পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করেন এবং দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেন।”
আন্দোলন প্রত্যাহারে অনুরোধ, কিন্তু এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণে আপত্তি
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, যেন তারা শর্তহীনভাবে কাজে ফিরে যান এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ‘এখন আর দোষারোপের সময় নয়, এখন সমাধানের সময়।’
তবে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের কথা বললেও, তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণের পক্ষে নয়। তাদের মতে, ব্যক্তি পরিবর্তন নয়, দরকার কাঠামোগত সমাধান।
সংকট দীর্ঘায়িত হলে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে যদি অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হয়, তবে কেবল আমদানি-রপ্তানি নয়, শিল্প, কৃষি, ভোক্তা বাজার—সব কিছুতেই ধস নামবে। ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চরম চাপের মুখে পড়েছে।
সরকার, এনবিআর এবং আন্দোলনরত কর্মকর্তা—সবার দায়িত্ব এখন একটাই হওয়া উচিত: দ্রুততম সময়ে সমাধান বের করা। নয়তো, আড়াই হাজার কোটি টাকার এই দৈনিক ক্ষতি আর কেবল ব্যবসায়ীদের বিষয় থাকবে না—এটি হয়ে উঠবে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সম্ভাবনার সবচেয়ে বড় বাধা।