এনবিআরের সংস্কার বিরোধিতা, অনিয়ম ও সরকারের ভূমিকা: জনগণের আস্থা হারাচ্ছে রাজস্ব খাত

- Update Time : ০৬:১৮:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
- / ৯৭ Time View

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই প্রতিষ্ঠান দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে, যার মাধ্যমে পরিচালিত হয় রাষ্ট্রের বাজেট, উন্নয়ন কার্যক্রম, ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, কর্মবিরতি ও অনিয়ম—সব মিলিয়ে সংস্থাটি বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখোমুখি।
প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন মহলে আলোচনায় উঠে আসছে যে, এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা সরকার নির্ধারিত নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, ঘুষ লেনদেন, ভুয়া রিফান্ড ছাড় ও কর ফাঁকির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ বিরোধীও বটে।
প্রশ্ন হচ্ছে—সরকার এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? কিসের এত ভয় বা স্বার্থ জড়িত যে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার অনিয়ম দিনের পর দিন চলে গেলেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না?
এনবিআর দ্বিখণ্ডিত করার সরকারি
সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ে গতি আনা। কিন্তু এনবিআরের অধীন কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা এ সিদ্ধান্তকে ‘তড়িঘড়ি ও অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন।
২৩ জুন থেকে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ ও ‘কলম বিরতি’ দিয়ে শুরু হয় আন্দোলন। এরপর ২৮ জুন থেকে শুরু হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এবং ‘মার্চ টু এনবিআর’ নামের যুগপৎ আন্দোলন, যা আজ (২৯ জুন) পর্যন্ত চলমান রয়েছে। আন্দোলনকারীদের ব্যানারে থাকা এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, তাদের দাবি মানা না হলে এই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করা হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বিবৃতি আসলেও ঐক্য পরিষদ বলছে, আলোচনা বা সমঝোতার জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
প্রধান কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভ, নিরাপত্তা ও অচলাবস্থা
শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআরের প্রধান কার্যালয় ঘিরে অবস্থান নেন শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দফতরে কাজ বন্ধ রাখা হয়। শুধু আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা—যেমন বন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বা জরুরি পণ্য ছাড়ের কার্যক্রম এই শাটডাউনের বাইরে রাখা হয়।
এনবিআরের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে বেশিরভাগ কর্মী অফিসে প্রবেশ করতে পারেননি। গত ২৬ জুনেও একই কৌশলে কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়, যা সংস্থার কার্যক্রমকে পুরোপুরি স্থবির করে দেয়।
জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অনাস্থা
এনবিআরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন—যদি এসব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত না থাকেন, তবে কেন তারা নিয়ম মেনে চলেন না? কেন তারা সরকারি নির্দেশনা ও নৈতিকতা লঙ্ঘন করেন? সরকার যেখানে বারবার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের কথা বলছে, সেখানে এনবিআরের কর্মকর্তারা সেই বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক আচরণ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনবিআরের এই অনিয়ম শুধু প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভ্যাট ফাঁকি, আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি-বাণিজ্যে ভুয়া দাবি ও কর ফাঁকির কারণে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
সরকারের দায়িত্ব: শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি
এনবিআর শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নয়—এটি দেশের রাজস্ব চালিকা শক্তি। এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম, সততা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে দেশের আর্থিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সরকারকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, যেসব কর্মকর্তা সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিবিরোধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, রাজস্ব বিভাগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে, যাতে ব্যক্তিপর্যায়ের ইচ্ছাকৃত অনিয়ম বন্ধ হয়।
প্রশ্নবিদ্ধ প্রশাসন, অনিয়ম ও সরকারি নীরবতা
এনবিআরের এই চলমান সংকট কেবল প্রশাসনিক বিরোধ নয়—এটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। অনেক সময় দেখা যায়, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি নীতিমালা ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত নেন। শুল্ক ছাড়পত্রে অনিয়ম, ভ্যাট রিফান্ডে দুর্নীতি, কর ফাঁকি প্রশ্রয়—এসব অভিযোগ বহুদিন ধরেই প্রচলিত।
জনগণের প্রশ্ন—যদি এই কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত না হন, তাহলে কেন তারা সরকারের সিদ্ধান্ত মানছেন না? কেন তারা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কাজ না করে নিজেদের স্বার্থে অবস্থান নিচ্ছেন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও নাগরিক সমাজে এনবিআরের এই আচরণের তীব্র সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকার নিজেই এনবিআরকে দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব করতে উদ্যোগী হয়েছে, অথচ কর্মকর্তাদের একাংশ সেই পরিবর্তনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারের ভূমিকা ও ব্যর্থতা
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—সরকার কেন এখনো এই আন্দোলনের সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে? সরকার যদি এনবিআরের সংস্কারে আন্তরিক হয়, তাহলে এই সঙ্কট নিরসনের জন্য আরও সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটি মধ্যমপন্থা খুঁজে বের করা যেত।
কিন্তু বরং দেখা যাচ্ছে, সরকার একদিকে এনবিআর ভাঙার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে, আরেকদিকে আন্দোলনকারীদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে একতরফা বিবৃতি দিচ্ছে—যা সংকটকে আরও গভীর করছে। যদি সরকার এনবিআরকে সংস্কার করতে চায়, তবে প্রয়োজন একটি সহজ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ, যাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত ও স্বার্থ বিবেচনায় রাখা হয়।
রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ, ঝুঁকিতে বাজেট বাস্তবায়ন
বর্তমান শাটডাউন ও কলম বিরতির কারণে রাজস্ব আহরণ কার্যত থেমে গেছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর অফিসগুলো থেকে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে সরকারকে বাজেট বাস্তবায়নে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন এনবিআরের মাধ্যমে গড়ে প্রায় ৮০০–১০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো। এই শাটডাউনের কারণে গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ৫,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা দেশের জন্য এক বিশাল ক্ষতি। বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রয়োজন একটি বাস্তবভিত্তিক ও সম্মানজনক সমাধান
সরকার ও এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চলমান এই দ্বন্দ্বের সমাধান ছাড়া রাজস্ব খাতকে সুশৃঙ্খল করা সম্ভব নয়। সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—একদিকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, অন্যদিকে যারা সৎ ও সংস্কারবান্ধব, তাদের নিয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
একইসাথে এনবিআরের কর্মকর্তাদেরও ভাবতে হবে—তারা জনগণের টাকায় বেতন নেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তাদের আন্দোলন যদি দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তা আলোচনা ও গঠনমূলক উপায়ে জানাতে হবে, দায়িত্ববোধ বজায় রেখেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা, বাজেট বাস্তবায়ন এবং জনমানসে সরকারের ভাবমূর্তিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। সরকারের উচিত অবিলম্বে সমঝোতার মাধ্যমে সংকট নিরসন করা এবং দীর্ঘমেয়াদে এনবিআরকে একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
কারণ, রাজস্ব যদি না আসে, উন্নয়নও থেমে যাবে। আর জনগণের বিশ্বাস যদি হারিয়ে যায়, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। আজই প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা। এনবিআর সংকটের সমাধান হবে তখনই, যখন সরকার ও কর্মকর্তারা বুঝবেন—এই রাজস্ব খাত দেশের হৃদস্পন্দন, এর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া মানেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
Please Share This Post in Your Social Media

এনবিআরের সংস্কার বিরোধিতা, অনিয়ম ও সরকারের ভূমিকা: জনগণের আস্থা হারাচ্ছে রাজস্ব খাত


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই প্রতিষ্ঠান দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে, যার মাধ্যমে পরিচালিত হয় রাষ্ট্রের বাজেট, উন্নয়ন কার্যক্রম, ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, কর্মবিরতি ও অনিয়ম—সব মিলিয়ে সংস্থাটি বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখোমুখি।
প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন মহলে আলোচনায় উঠে আসছে যে, এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা সরকার নির্ধারিত নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, ঘুষ লেনদেন, ভুয়া রিফান্ড ছাড় ও কর ফাঁকির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ বিরোধীও বটে।
প্রশ্ন হচ্ছে—সরকার এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? কিসের এত ভয় বা স্বার্থ জড়িত যে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার অনিয়ম দিনের পর দিন চলে গেলেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না?
এনবিআর দ্বিখণ্ডিত করার সরকারি সিদ্ধান্ত
সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ে গতি আনা। কিন্তু এনবিআরের অধীন কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা এ সিদ্ধান্তকে ‘তড়িঘড়ি ও অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন।
২৩ জুন থেকে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ ও ‘কলম বিরতি’ দিয়ে শুরু হয় আন্দোলন। এরপর ২৮ জুন থেকে শুরু হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এবং ‘মার্চ টু এনবিআর’ নামের যুগপৎ আন্দোলন, যা আজ (২৯ জুন) পর্যন্ত চলমান রয়েছে। আন্দোলনকারীদের ব্যানারে থাকা এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, তাদের দাবি মানা না হলে এই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করা হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বিবৃতি আসলেও ঐক্য পরিষদ বলছে, আলোচনা বা সমঝোতার জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
প্রধান কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভ, নিরাপত্তা ও অচলাবস্থা
শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআরের প্রধান কার্যালয় ঘিরে অবস্থান নেন শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দফতরে কাজ বন্ধ রাখা হয়। শুধু আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা—যেমন বন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বা জরুরি পণ্য ছাড়ের কার্যক্রম এই শাটডাউনের বাইরে রাখা হয়।
এনবিআরের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে বেশিরভাগ কর্মী অফিসে প্রবেশ করতে পারেননি। গত ২৬ জুনেও একই কৌশলে কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়, যা সংস্থার কার্যক্রমকে পুরোপুরি স্থবির করে দেয়।
জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অনাস্থা
এনবিআরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন—যদি এসব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত না থাকেন, তবে কেন তারা নিয়ম মেনে চলেন না? কেন তারা সরকারি নির্দেশনা ও নৈতিকতা লঙ্ঘন করেন? সরকার যেখানে বারবার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের কথা বলছে, সেখানে এনবিআরের কর্মকর্তারা সেই বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক আচরণ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনবিআরের এই অনিয়ম শুধু প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভ্যাট ফাঁকি, আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি-বাণিজ্যে ভুয়া দাবি ও কর ফাঁকির কারণে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
সরকারের দায়িত্ব: শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি
এনবিআর শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নয়—এটি দেশের রাজস্ব চালিকা শক্তি। এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম, সততা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে দেশের আর্থিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সরকারকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, যেসব কর্মকর্তা সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিবিরোধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, রাজস্ব বিভাগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে, যাতে ব্যক্তিপর্যায়ের ইচ্ছাকৃত অনিয়ম বন্ধ হয়।
প্রশ্নবিদ্ধ প্রশাসন, অনিয়ম ও সরকারি নীরবতা
এনবিআরের এই চলমান সংকট কেবল প্রশাসনিক বিরোধ নয়—এটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। অনেক সময় দেখা যায়, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি নীতিমালা ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত নেন। শুল্ক ছাড়পত্রে অনিয়ম, ভ্যাট রিফান্ডে দুর্নীতি, কর ফাঁকি প্রশ্রয়—এসব অভিযোগ বহুদিন ধরেই প্রচলিত।
জনগণের প্রশ্ন—যদি এই কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত না হন, তাহলে কেন তারা সরকারের সিদ্ধান্ত মানছেন না? কেন তারা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কাজ না করে নিজেদের স্বার্থে অবস্থান নিচ্ছেন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও নাগরিক সমাজে এনবিআরের এই আচরণের তীব্র সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকার নিজেই এনবিআরকে দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব করতে উদ্যোগী হয়েছে, অথচ কর্মকর্তাদের একাংশ সেই পরিবর্তনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারের ভূমিকা ও ব্যর্থতা
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—সরকার কেন এখনো এই আন্দোলনের সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে? সরকার যদি এনবিআরের সংস্কারে আন্তরিক হয়, তাহলে এই সঙ্কট নিরসনের জন্য আরও সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটি মধ্যমপন্থা খুঁজে বের করা যেত।
কিন্তু বরং দেখা যাচ্ছে, সরকার একদিকে এনবিআর ভাঙার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে, আরেকদিকে আন্দোলনকারীদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে একতরফা বিবৃতি দিচ্ছে—যা সংকটকে আরও গভীর করছে। যদি সরকার এনবিআরকে সংস্কার করতে চায়, তবে প্রয়োজন একটি সহজ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ, যাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত ও স্বার্থ বিবেচনায় রাখা হয়।
রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ, ঝুঁকিতে বাজেট বাস্তবায়ন
বর্তমান শাটডাউন ও কলম বিরতির কারণে রাজস্ব আহরণ কার্যত থেমে গেছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর অফিসগুলো থেকে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে সরকারকে বাজেট বাস্তবায়নে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন এনবিআরের মাধ্যমে গড়ে প্রায় ৮০০–১০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো। এই শাটডাউনের কারণে গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ৫,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা দেশের জন্য এক বিশাল ক্ষতি। বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রয়োজন একটি বাস্তবভিত্তিক ও সম্মানজনক সমাধান
সরকার ও এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চলমান এই দ্বন্দ্বের সমাধান ছাড়া রাজস্ব খাতকে সুশৃঙ্খল করা সম্ভব নয়। সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—একদিকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, অন্যদিকে যারা সৎ ও সংস্কারবান্ধব, তাদের নিয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
একইসাথে এনবিআরের কর্মকর্তাদেরও ভাবতে হবে—তারা জনগণের টাকায় বেতন নেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তাদের আন্দোলন যদি দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তা আলোচনা ও গঠনমূলক উপায়ে জানাতে হবে, দায়িত্ববোধ বজায় রেখেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা, বাজেট বাস্তবায়ন এবং জনমানসে সরকারের ভাবমূর্তিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। সরকারের উচিত অবিলম্বে সমঝোতার মাধ্যমে সংকট নিরসন করা এবং দীর্ঘমেয়াদে এনবিআরকে একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
কারণ, রাজস্ব যদি না আসে, উন্নয়নও থেমে যাবে। আর জনগণের বিশ্বাস যদি হারিয়ে যায়, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। আজই প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা। এনবিআর সংকটের সমাধান হবে তখনই, যখন সরকার ও কর্মকর্তারা বুঝবেন—এই রাজস্ব খাত দেশের হৃদস্পন্দন, এর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া মানেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।