অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ: মালয়েশিয়ায় ৩৬ উগ্রপন্থী বাংলাদেশি আটক

- Update Time : ০৩:৫৭:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
- / ১৩৫ Time View
মালয়েশিয়ায় বসবাসরত কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের একটি চরমপন্থী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে মালয়েশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশটির রয়েল মালয়েশিয়ান পুলিশ (PDRM) ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালিত একটি গোপন অভিযানে ৩৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করেছে, যারা উগ্রবাদী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
তিন ধাপে পরিচালিত নিরাপত্তা অভিযান
PDRM-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও মালয়েশিয়ার প্রধান সংবাদমাধ্যম Astro Awani, TV3, Kosmo Digital এবং The Star-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ এপ্রিল শুরু হওয়া এই অভিযানটি সেলাঙ্গর এবং জোহর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তিনটি পৃথক ধাপে পরিচালিত হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে আটক ব্যক্তিরা গোপনে আইএস মতাদর্শ প্রচারের পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ, সদস্য নিয়োগ এবং বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা
আটককৃতদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার দণ্ডবিধির “Security Offences (Special Measures) Act 2012” (SOSMA) এর অধীনে মামলা রুজু করে শাহ আলম এবং জোহর বাহরুর আদালতে হাজির করা হয়েছে। ১৫ জনকে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তদন্ত চলছে।
উগ্রবাদী পরিকল্পনা ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা
PDRM-এর স্পেশাল ব্রাঞ্চ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই চক্রটি আইএস মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মালয়েশিয়ায় বসে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাঝে উগ্রবাদ ছড়াতে একটি “রিক্রুটমেন্ট সেল” গঠন করেছিল। এই সেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের যুবকদের চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ করা, অর্থ সংগ্রহ এবং বাংলাদেশে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে। এই চক্রটি সেই প্রচেষ্টারই একটি অংশ।
মালয়েশিয়ার শক্ত বার্তা
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Ministry of Home Affairs) এক বিবৃতিতে স্পষ্ট জানিয়েছে, “মালয়েশিয়া কখনোই কোনো বিদেশি চরমপন্থী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার ঘাঁটি হতে দেবে না।” মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, এই অভিযান মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়নের একটি দৃষ্টান্ত।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া অতীতেও বিদেশি নাগরিকদের চরমপন্থী কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারণে গ্রেপ্তার করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালে একটি অভিযানে ৮ জন বিদেশিকে আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকও ছিল।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মালয়েশিয়ার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসিউশন এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা দেশের শান্তি রক্ষায় আপসহীন। যেকোনো উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ড আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রাখছি।”
বাংলাদেশের উদ্বেগ ও করণীয়
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার এই ঘটনার ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আটক ব্যক্তিদের পরিচয় ও অপরাধের ধরন জানতে চেয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি প্রবাসীদের প্রতি আইন মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশ সরকারের জন্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি স্বরূপ। প্রবাসী কমিউনিটিতে আইএস মতাদর্শের বিস্তার প্রতিরোধে আরও কড়া নজরদারি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
মালয়েশিয়ায় ৩৬ জন বাংলাদেশি চরমপন্থীর আটক ও বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়া একদিকে যেমন মালয়েশিয়ার কঠোর নিরাপত্তানীতির ফল, অন্যদিকে এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সতর্ক সংকেত। এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হলো যে, চরমপন্থা আজ আর কেবল এক দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। এজন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, দ্রুত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই হুমকির মোকাবিলা করতে হবে।
তথ্যসূত্র:
- Astro Awani (24 April 2025)
- Kosmo Digital (25 April 2025)
- The Star Malaysia
- Malaysian Ministry of Home Affairs Press Statement
- PDRM Official Facebook Page
- Interviews with Security Analysts in Kuala Lumpur and Dhaka
Please Share This Post in Your Social Media

অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ: মালয়েশিয়ায় ৩৬ উগ্রপন্থী বাংলাদেশি আটক

মালয়েশিয়ায় বসবাসরত কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের একটি চরমপন্থী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে মালয়েশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশটির রয়েল মালয়েশিয়ান পুলিশ (PDRM) ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালিত একটি গোপন অভিযানে ৩৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করেছে, যারা উগ্রবাদী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
তিন ধাপে পরিচালিত নিরাপত্তা অভিযান
PDRM-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও মালয়েশিয়ার প্রধান সংবাদমাধ্যম Astro Awani, TV3, Kosmo Digital এবং The Star-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ এপ্রিল শুরু হওয়া এই অভিযানটি সেলাঙ্গর এবং জোহর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তিনটি পৃথক ধাপে পরিচালিত হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে আটক ব্যক্তিরা গোপনে আইএস মতাদর্শ প্রচারের পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ, সদস্য নিয়োগ এবং বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা
আটককৃতদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার দণ্ডবিধির “Security Offences (Special Measures) Act 2012” (SOSMA) এর অধীনে মামলা রুজু করে শাহ আলম এবং জোহর বাহরুর আদালতে হাজির করা হয়েছে। ১৫ জনকে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তদন্ত চলছে।
উগ্রবাদী পরিকল্পনা ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা
PDRM-এর স্পেশাল ব্রাঞ্চ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই চক্রটি আইএস মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মালয়েশিয়ায় বসে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাঝে উগ্রবাদ ছড়াতে একটি “রিক্রুটমেন্ট সেল” গঠন করেছিল। এই সেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের যুবকদের চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ করা, অর্থ সংগ্রহ এবং বাংলাদেশে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে। এই চক্রটি সেই প্রচেষ্টারই একটি অংশ।
মালয়েশিয়ার শক্ত বার্তা
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Ministry of Home Affairs) এক বিবৃতিতে স্পষ্ট জানিয়েছে, “মালয়েশিয়া কখনোই কোনো বিদেশি চরমপন্থী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার ঘাঁটি হতে দেবে না।” মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, এই অভিযান মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়নের একটি দৃষ্টান্ত।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া অতীতেও বিদেশি নাগরিকদের চরমপন্থী কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারণে গ্রেপ্তার করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালে একটি অভিযানে ৮ জন বিদেশিকে আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকও ছিল।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মালয়েশিয়ার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসিউশন এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা দেশের শান্তি রক্ষায় আপসহীন। যেকোনো উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ড আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রাখছি।”
বাংলাদেশের উদ্বেগ ও করণীয়
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার এই ঘটনার ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আটক ব্যক্তিদের পরিচয় ও অপরাধের ধরন জানতে চেয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি প্রবাসীদের প্রতি আইন মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশ সরকারের জন্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি স্বরূপ। প্রবাসী কমিউনিটিতে আইএস মতাদর্শের বিস্তার প্রতিরোধে আরও কড়া নজরদারি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
মালয়েশিয়ায় ৩৬ জন বাংলাদেশি চরমপন্থীর আটক ও বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়া একদিকে যেমন মালয়েশিয়ার কঠোর নিরাপত্তানীতির ফল, অন্যদিকে এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সতর্ক সংকেত। এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হলো যে, চরমপন্থা আজ আর কেবল এক দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। এজন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, দ্রুত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই হুমকির মোকাবিলা করতে হবে।
তথ্যসূত্র:
- Astro Awani (24 April 2025)
- Kosmo Digital (25 April 2025)
- The Star Malaysia
- Malaysian Ministry of Home Affairs Press Statement
- PDRM Official Facebook Page
- Interviews with Security Analysts in Kuala Lumpur and Dhaka