রিজার্ভ ছাড়ালো ২৭ বিলিয়ন ডলার: আইএমএফ থেকে ১৩০ কোটি ডলার পাওয়ায় নতুন আশার আলো

- Update Time : ১১:০৭:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
- / ৯৫ Time View
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরনের এক ইতিবাচক ধাক্কা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে একযোগে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির আওতায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ ছাড় হওয়ায় দেশের রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে। এই ঋণ অনুমোদনের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর যে চাপ বিরাজ করছিল, তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে এবং সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর আন্তর্জাতিক আস্থা পুনঃস্থাপিত হয়েছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আইএমএফের বোর্ড সভায় সোমবার (২৪ জুন) একসঙ্গে দুই কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়, যার মোট পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ এখন ২৭.৩১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বিপিএম৬ (Balance of Payments Manual 6th edition) মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাব করলে এই রিজার্ভও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
সাম্প্রতিক রিজার্ভের গতিপ্রকৃতি:
গত ২৩ জুন পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৬.৮২ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম৬ অনুযায়ী তা ছিল ২১.৭৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ১৫ জুন পর্যন্ত এই রিজার্ভ ছিল যথাক্রমে ২৬.১৫ বিলিয়ন এবং ২০.৮৬ বিলিয়ন ডলার। আর ২৭ মে পর্যন্ত ছিল ২৫.৮০ বিলিয়ন (গ্রস) এবং ২০.৫৬ বিলিয়ন (বিপিএম৬ অনুযায়ী)। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভে একটা ধীরগতির ঊর্ধ্বমুখী ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা এই ঋণ ছাড়ের ফলে আরও গতি পেয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালের জুন মাসে রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এরপর তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়নে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ রিজার্ভ পৌঁছে যায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। এরপর অক্টোবরে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে, কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সংকট ও পতন:
তবে ২০২২ সালের পর থেকে চিত্র বদলাতে শুরু করে। বৈশ্বিক ডলার সংকট, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন আমদানি ব্যয়ের উচ্চতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে শ্লথতা ও বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা—সব মিলিয়ে রিজার্ভে নেমে আসে পতনের ছায়া। এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি বিল পরিশোধের জন্য রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে, যার ফলে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেতে থাকে।
আইএমএফ ঋণ ও অর্থনীতির বার্তা:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের এই ঋণ ছাড় দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি কেবল আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি যে বাংলাদেশ এখনো সংস্কারমুখী এবং দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী। এই ঋণের ফলে সরকারের হাতে বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থাপনায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে এবং তা বাজারে ডলার পরিস্থিতিকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিন মাসের রিজার্ভ নীতি ও বর্তমান অবস্থান:
আন্তর্জাতিকভাবে একটি গ্রহণযোগ্য অর্থনীতির জন্য মূলনীতি হলো—যেকোনো দেশের রিজার্ভে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় সমপরিমাণ মুদ্রা থাকা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ প্রায় ২৬-২৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক ঋণ ছাড়ের ফলে রিজার্ভ এখন সেই নিরাপত্তা সীমার কাছাকাছি রয়েছে, যা কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও অর্থনীতির জন্য সতর্কবার্তা বহন করে। কেননা, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান নয়।
বাংলাদেশের রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সংবাদ, বিশেষ করে যখন অর্থনীতির ওপর বহুমাত্রিক চাপ বিরাজ করছে। তবে এই ঋণের টেকসই ব্যবহার এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতিকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে হলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ, রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং প্রবাসী আয় বাড়ানোর দিকেই মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রবাহের চাপে থাকা বিশ্বব্যবস্থায় স্থিতিশীল রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্যতম মাপকাঠি।
Please Share This Post in Your Social Media

রিজার্ভ ছাড়ালো ২৭ বিলিয়ন ডলার: আইএমএফ থেকে ১৩০ কোটি ডলার পাওয়ায় নতুন আশার আলো

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরনের এক ইতিবাচক ধাক্কা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে একযোগে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির আওতায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ ছাড় হওয়ায় দেশের রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে। এই ঋণ অনুমোদনের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর যে চাপ বিরাজ করছিল, তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে এবং সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর আন্তর্জাতিক আস্থা পুনঃস্থাপিত হয়েছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আইএমএফের বোর্ড সভায় সোমবার (২৪ জুন) একসঙ্গে দুই কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়, যার মোট পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ এখন ২৭.৩১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বিপিএম৬ (Balance of Payments Manual 6th edition) মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাব করলে এই রিজার্ভও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
সাম্প্রতিক রিজার্ভের গতিপ্রকৃতি:
গত ২৩ জুন পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৬.৮২ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম৬ অনুযায়ী তা ছিল ২১.৭৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ১৫ জুন পর্যন্ত এই রিজার্ভ ছিল যথাক্রমে ২৬.১৫ বিলিয়ন এবং ২০.৮৬ বিলিয়ন ডলার। আর ২৭ মে পর্যন্ত ছিল ২৫.৮০ বিলিয়ন (গ্রস) এবং ২০.৫৬ বিলিয়ন (বিপিএম৬ অনুযায়ী)। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভে একটা ধীরগতির ঊর্ধ্বমুখী ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা এই ঋণ ছাড়ের ফলে আরও গতি পেয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালের জুন মাসে রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এরপর তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়নে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ রিজার্ভ পৌঁছে যায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। এরপর অক্টোবরে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে, কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সংকট ও পতন:
তবে ২০২২ সালের পর থেকে চিত্র বদলাতে শুরু করে। বৈশ্বিক ডলার সংকট, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন আমদানি ব্যয়ের উচ্চতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে শ্লথতা ও বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা—সব মিলিয়ে রিজার্ভে নেমে আসে পতনের ছায়া। এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি বিল পরিশোধের জন্য রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে, যার ফলে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেতে থাকে।
আইএমএফ ঋণ ও অর্থনীতির বার্তা:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের এই ঋণ ছাড় দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি কেবল আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি যে বাংলাদেশ এখনো সংস্কারমুখী এবং দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী। এই ঋণের ফলে সরকারের হাতে বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থাপনায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে এবং তা বাজারে ডলার পরিস্থিতিকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিন মাসের রিজার্ভ নীতি ও বর্তমান অবস্থান:
আন্তর্জাতিকভাবে একটি গ্রহণযোগ্য অর্থনীতির জন্য মূলনীতি হলো—যেকোনো দেশের রিজার্ভে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় সমপরিমাণ মুদ্রা থাকা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ প্রায় ২৬-২৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক ঋণ ছাড়ের ফলে রিজার্ভ এখন সেই নিরাপত্তা সীমার কাছাকাছি রয়েছে, যা কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও অর্থনীতির জন্য সতর্কবার্তা বহন করে। কেননা, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান নয়।
বাংলাদেশের রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সংবাদ, বিশেষ করে যখন অর্থনীতির ওপর বহুমাত্রিক চাপ বিরাজ করছে। তবে এই ঋণের টেকসই ব্যবহার এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতিকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে হলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ, রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং প্রবাসী আয় বাড়ানোর দিকেই মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রবাহের চাপে থাকা বিশ্বব্যবস্থায় স্থিতিশীল রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্যতম মাপকাঠি।