ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার: দুর্নীতিবাজরা আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতা

- Update Time : ১২:২৮:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
- / ১১৫ Time View
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত একটি অধ্যায়ের মুখোমুখি এখন দেশ। দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মনিরুল মাওলাকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ২২ জুন দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, দুর্নীতিবাজ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
গ্রেপ্তারের পেছনের পটভূমি
মনিরুল মাওলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিক মামলা করেছে। এসব মামলায় অভিযোগ রয়েছে, তার মেয়াদকালে বিভিন্ন অসাধু উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাইরে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটি থেকে বেরিয়ে গেছে, যার বড় একটি অংশ ঘটেছে মনিরুল মাওলার দায়িত্বকালেই।
বিশেষ করে ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ‘মুরাদ এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে দুদক গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মনিরুল মাওলাসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই মামলার প্রধান আসামিদের মধ্যে আছেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার আহসানুল আলম, যিনি সেই সময় ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এস আলম গ্রুপ, ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ এবং ‘ক্যাপচার’-এর অভিযোগ
এস আলম গ্রুপের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ এবং ঋণ কাঠামো প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ বহুদিনের। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি ধরনের ‘ক্রনিক কর্পোরেট ক্যাপচার’, যেখানে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিজ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করে।
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের অধিকাংশ ডিরেক্টর এবং সিনিয়র কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু মনিরুল মাওলা তখনো বহাল তবিয়তে ছিলেন, যদিও পরে তাকে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে ছুটিতে পাঠানো হয়।
আইন ও ন্যায়ের বার্তা
মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার শুধু একজন ব্যক্তির বিচারের সূচনা নয়; এটি একটি বার্তা – দুর্নীতিবাজেরা আর নিরাপদ নয়। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, ও অর্থনীতিবিদরা যে প্রশ্ন করে আসছিলেন – ‘এই দুর্নীতিগুলো কে করেছে, কারা সুবিধা নিয়েছে, কেন তাদের বিচার হচ্ছে না?’ – এই গ্রেপ্তারে সেই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মিলেছে।
বাংলাদেশে বহুবার দেখা গেছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যান। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষ দেখছে, ধীরে হলেও বিচারের চাকা ঘুরছে।
অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাংকিং খাতের অবস্থা
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, রপ্তানি আয় হ্রাস, রেমিট্যান্স প্রবাহের অনিশ্চয়তা এবং খেলাপি ঋণের পাহাড় – সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক গভীর সঙ্কটে নিপতিত। এর পেছনে বড় একটি ভূমিকা রাখছে ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতকে দুর্নীতিমুক্ত না করলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ধ্বংসের দিকে যাবে। ইসলামী ব্যাংকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে যদি এভাবে জালিয়াতি হয় এবং তা যদি বছরের পর বছর ধরে গোপনে চলতে থাকে, তাহলে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে কীভাবে?
পরিশেষে
মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি প্রতীক – দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট করার। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। এস আলম গ্রুপ, ব্যাংকের অন্যান্য পরিচালক, এবং যেসব সরকারি কর্মকর্তা এই দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন – সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের আরও সাহসী ভূমিকা নেওয়ার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচার বিভাগের উচিত রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ব্যাংকিং খাতকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে তোলা।
এই অভিযান যেন হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের শুরু, আর মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার – একটি প্রমাণ, “কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
Please Share This Post in Your Social Media

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার: দুর্নীতিবাজরা আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতা

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত একটি অধ্যায়ের মুখোমুখি এখন দেশ। দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মনিরুল মাওলাকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ২২ জুন দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, দুর্নীতিবাজ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
গ্রেপ্তারের পেছনের পটভূমি
মনিরুল মাওলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিক মামলা করেছে। এসব মামলায় অভিযোগ রয়েছে, তার মেয়াদকালে বিভিন্ন অসাধু উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাইরে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটি থেকে বেরিয়ে গেছে, যার বড় একটি অংশ ঘটেছে মনিরুল মাওলার দায়িত্বকালেই।
বিশেষ করে ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ‘মুরাদ এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে দুদক গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মনিরুল মাওলাসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই মামলার প্রধান আসামিদের মধ্যে আছেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার আহসানুল আলম, যিনি সেই সময় ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এস আলম গ্রুপ, ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ এবং ‘ক্যাপচার’-এর অভিযোগ
এস আলম গ্রুপের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ এবং ঋণ কাঠামো প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ বহুদিনের। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি ধরনের ‘ক্রনিক কর্পোরেট ক্যাপচার’, যেখানে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিজ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করে।
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের অধিকাংশ ডিরেক্টর এবং সিনিয়র কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু মনিরুল মাওলা তখনো বহাল তবিয়তে ছিলেন, যদিও পরে তাকে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে ছুটিতে পাঠানো হয়।
আইন ও ন্যায়ের বার্তা
মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার শুধু একজন ব্যক্তির বিচারের সূচনা নয়; এটি একটি বার্তা – দুর্নীতিবাজেরা আর নিরাপদ নয়। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, ও অর্থনীতিবিদরা যে প্রশ্ন করে আসছিলেন – ‘এই দুর্নীতিগুলো কে করেছে, কারা সুবিধা নিয়েছে, কেন তাদের বিচার হচ্ছে না?’ – এই গ্রেপ্তারে সেই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মিলেছে।
বাংলাদেশে বহুবার দেখা গেছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যান। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষ দেখছে, ধীরে হলেও বিচারের চাকা ঘুরছে।
অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাংকিং খাতের অবস্থা
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, রপ্তানি আয় হ্রাস, রেমিট্যান্স প্রবাহের অনিশ্চয়তা এবং খেলাপি ঋণের পাহাড় – সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক গভীর সঙ্কটে নিপতিত। এর পেছনে বড় একটি ভূমিকা রাখছে ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতকে দুর্নীতিমুক্ত না করলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ধ্বংসের দিকে যাবে। ইসলামী ব্যাংকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে যদি এভাবে জালিয়াতি হয় এবং তা যদি বছরের পর বছর ধরে গোপনে চলতে থাকে, তাহলে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে কীভাবে?
পরিশেষে
মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি প্রতীক – দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট করার। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। এস আলম গ্রুপ, ব্যাংকের অন্যান্য পরিচালক, এবং যেসব সরকারি কর্মকর্তা এই দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন – সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের আরও সাহসী ভূমিকা নেওয়ার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচার বিভাগের উচিত রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ব্যাংকিং খাতকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে তোলা।
এই অভিযান যেন হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের শুরু, আর মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার – একটি প্রমাণ, “কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”