ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন তিন সাবেক গভর্নর

- Update Time : ১১:৩২:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
- / ১৬৬ Time View
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন। গত ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আর্থিক খাতে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে থাকা পরপর তিনজন গভর্নরের আমলে এই খাতের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কার্যত হারিয়ে গেছে, এবং এক শ্রেণির সুবিধাভোগী গোষ্ঠী পুরো ব্যবস্থাকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এই সময়েই রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রগুলো দুর্বল নীতিমালার সুযোগ নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে, যা এখনো আদায় হয়নি। অথচ এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকা তিন গভর্নর—আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আবদুর রউফ তালুকদার—কেউই আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের জবাবদিহির আওতায় আসেননি।
ব্যাংক খাত—এক ‘ব্ল্যাক হোল’
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে গঠিত সরকারি ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ দেশের ব্যাংক খাতকে একটি ‘ব্ল্যাক হোল’ বা কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার ভেতরে প্রতিনিয়ত সরকারি অর্থ ঢুকছে কিন্তু কোনো কিছুই ফিরে আসছে না। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে মোট দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বড় একটি অংশই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া হয়েছে, যার পুনঃপ্রদান হয়নি। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, আর ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। মূলধন ঘাটতি পূরণ, ঋণ পুনর্গঠন ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার নামে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ হারিয়ে গেছে জনগণের হাতছাড়া হয়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আতিউর রহমান : অনিয়মের সূচনা, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
২০০৯ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুরুর দিকে তিনি ‘পিপলস গভর্নর’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও, পরবর্তীতে ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের সূচনা তাঁর সময়েই শুরু হয়। তাঁর আমলে ঘটে দেশের ব্যাংক ইতিহাসের অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি—সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, যেখানে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একই সময়ে বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগও প্রকাশ্যে আসে। এছাড়া আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের জন্য তাঁর আমলেই অনুমোদন পায় নয়টি নতুন ব্যাংক, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সমালোচিত হয়। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক চিঠির ভিত্তিতে বেক্সিমকোসহ একাধিক ব্যবসায়িক গ্রুপকে সুবিধা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। আতিউর রহমান আত্মপ্রচার ও মিডিয়ায় নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু ২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়, তখন জনগণের চাপ ও দায়িত্ব এড়ানোর পথ হিসেবে তিনি পদত্যাগ করেন।
ফজলে কবির : দখল ও লুটপাটের বৈধতা
২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির। তাঁর আমলে ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। এস আলম গ্রুপের মতো প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মত বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়। এই দখলের অনুমোদন গভীর রাতে, তার বাসায় বসেই দেওয়া হয়, যা পরে গণমাধ্যমে উঠে আসে। এস আলম গ্রুপ পরে এসব ব্যাংক ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। তাদের ঋণগ্রহণে কোনো নিয়ম মানা হয়নি এবং ঋণের গ্যারান্টি ছাড়াই অর্থ সরবরাহ করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলমের লোকজনের নিয়মিত আনাগোনা ছিল এবং গভর্নরের অনুমোদনে তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলত। ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, সরকার তাঁর মেয়াদ বাড়াতে আইন পরিবর্তন করে গভর্নরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করে। যা এক নজিরবিহীন ঘটনা এবং তৎকালীন সরকারের এস আলমপন্থী মনোভাবের পরিচয় বহন করে।
আবদুর রউফ তালুকদার : টাকা ছাপানোর গভর্নর
২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান আরেক সাবেক অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার। অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাজেট ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও গভর্নরের দায়িত্বে এসে তিনি মূলত সরকার ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই কাজ করেন। ব্যাংক খাতে লুটপাট ও আর্থিক সংকট সামাল দিতে তিনি বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে দেন। অথচ সেই অর্থ জনগণের হাতে পৌঁছায়নি—বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও এস আলম গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান সেই অর্থ ঋণের নামে নিয়ে তা আবার পাচার করে দেয় বিদেশে। তাঁর আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, যা ছিল স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতার পরিপন্থী। এছাড়া বার্ষিক রিপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ বন্ধ রাখা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে তিনি কার্যত একটি ‘বন্ধ গোপন প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত করেন। সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং পরে পদত্যাগ করেন।
১০ বিলিয়ন ডলার পাচার : গভর্নরের মুখেই অকপট স্বীকারোক্তি
বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, যিনি একজন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা, সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার আগামীতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় বিপদ। তিনি আরও জানান, বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় এস আলম গ্রুপ অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার—যার মূল্য প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ—বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তুলে নিয়েছে এবং দেশের বাইরে পাচার করেছে। এই অর্থ শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দুর্বল করেনি, বরং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে। এসব তথ্য গভর্নরের নিজ মুখে স্বীকারোক্তি হিসেবেই তুলে ধরেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এখনও ধরা–ছোঁয়ার বাইরে
এতসব ঘটনার পরও আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আবদুর রউফ তালুকদারের বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনি তদন্ত বা ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। বিভিন্ন অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা এবং গবেষণাপত্রে তাঁদের নাম বারবার আসলেও প্রশাসনিকভাবে তাঁরা আজও ‘অস্পর্শ্য’ থেকে গেছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আতিউর রহমান ও ফজলে কবিরের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, আর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে গেছেন। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে ব্যাংক খাত সংস্কারের কথা বললেও বাস্তবে এই গভর্নরদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশের ব্যাংকব্যবস্থা যখন ধ্বংসের প্রান্তে, তখন সেই ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারিগররা যদি আইনের বাইরে থাকেন, তাহলে জনগণের অর্থ নিরাপদ নয়। এই অবস্থা আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
Please Share This Post in Your Social Media

ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন তিন সাবেক গভর্নর

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন। গত ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আর্থিক খাতে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে থাকা পরপর তিনজন গভর্নরের আমলে এই খাতের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কার্যত হারিয়ে গেছে, এবং এক শ্রেণির সুবিধাভোগী গোষ্ঠী পুরো ব্যবস্থাকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এই সময়েই রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রগুলো দুর্বল নীতিমালার সুযোগ নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে, যা এখনো আদায় হয়নি। অথচ এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকা তিন গভর্নর—আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আবদুর রউফ তালুকদার—কেউই আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের জবাবদিহির আওতায় আসেননি।
ব্যাংক খাত—এক ‘ব্ল্যাক হোল’
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে গঠিত সরকারি ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ দেশের ব্যাংক খাতকে একটি ‘ব্ল্যাক হোল’ বা কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার ভেতরে প্রতিনিয়ত সরকারি অর্থ ঢুকছে কিন্তু কোনো কিছুই ফিরে আসছে না। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে মোট দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বড় একটি অংশই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া হয়েছে, যার পুনঃপ্রদান হয়নি। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, আর ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। মূলধন ঘাটতি পূরণ, ঋণ পুনর্গঠন ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার নামে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ হারিয়ে গেছে জনগণের হাতছাড়া হয়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আতিউর রহমান : অনিয়মের সূচনা, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
২০০৯ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুরুর দিকে তিনি ‘পিপলস গভর্নর’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও, পরবর্তীতে ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের সূচনা তাঁর সময়েই শুরু হয়। তাঁর আমলে ঘটে দেশের ব্যাংক ইতিহাসের অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি—সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, যেখানে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একই সময়ে বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগও প্রকাশ্যে আসে। এছাড়া আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের জন্য তাঁর আমলেই অনুমোদন পায় নয়টি নতুন ব্যাংক, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সমালোচিত হয়। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক চিঠির ভিত্তিতে বেক্সিমকোসহ একাধিক ব্যবসায়িক গ্রুপকে সুবিধা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। আতিউর রহমান আত্মপ্রচার ও মিডিয়ায় নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু ২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়, তখন জনগণের চাপ ও দায়িত্ব এড়ানোর পথ হিসেবে তিনি পদত্যাগ করেন।
ফজলে কবির : দখল ও লুটপাটের বৈধতা
২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির। তাঁর আমলে ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। এস আলম গ্রুপের মতো প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মত বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়। এই দখলের অনুমোদন গভীর রাতে, তার বাসায় বসেই দেওয়া হয়, যা পরে গণমাধ্যমে উঠে আসে। এস আলম গ্রুপ পরে এসব ব্যাংক ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। তাদের ঋণগ্রহণে কোনো নিয়ম মানা হয়নি এবং ঋণের গ্যারান্টি ছাড়াই অর্থ সরবরাহ করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলমের লোকজনের নিয়মিত আনাগোনা ছিল এবং গভর্নরের অনুমোদনে তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলত। ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, সরকার তাঁর মেয়াদ বাড়াতে আইন পরিবর্তন করে গভর্নরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করে। যা এক নজিরবিহীন ঘটনা এবং তৎকালীন সরকারের এস আলমপন্থী মনোভাবের পরিচয় বহন করে।
আবদুর রউফ তালুকদার : টাকা ছাপানোর গভর্নর
২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান আরেক সাবেক অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার। অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাজেট ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও গভর্নরের দায়িত্বে এসে তিনি মূলত সরকার ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই কাজ করেন। ব্যাংক খাতে লুটপাট ও আর্থিক সংকট সামাল দিতে তিনি বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে দেন। অথচ সেই অর্থ জনগণের হাতে পৌঁছায়নি—বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও এস আলম গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান সেই অর্থ ঋণের নামে নিয়ে তা আবার পাচার করে দেয় বিদেশে। তাঁর আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, যা ছিল স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতার পরিপন্থী। এছাড়া বার্ষিক রিপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ বন্ধ রাখা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে তিনি কার্যত একটি ‘বন্ধ গোপন প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত করেন। সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং পরে পদত্যাগ করেন।
১০ বিলিয়ন ডলার পাচার : গভর্নরের মুখেই অকপট স্বীকারোক্তি
বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, যিনি একজন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা, সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার আগামীতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় বিপদ। তিনি আরও জানান, বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় এস আলম গ্রুপ অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার—যার মূল্য প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ—বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তুলে নিয়েছে এবং দেশের বাইরে পাচার করেছে। এই অর্থ শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দুর্বল করেনি, বরং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে। এসব তথ্য গভর্নরের নিজ মুখে স্বীকারোক্তি হিসেবেই তুলে ধরেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এখনও ধরা–ছোঁয়ার বাইরে
এতসব ঘটনার পরও আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আবদুর রউফ তালুকদারের বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনি তদন্ত বা ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। বিভিন্ন অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা এবং গবেষণাপত্রে তাঁদের নাম বারবার আসলেও প্রশাসনিকভাবে তাঁরা আজও ‘অস্পর্শ্য’ থেকে গেছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আতিউর রহমান ও ফজলে কবিরের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, আর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে গেছেন। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে ব্যাংক খাত সংস্কারের কথা বললেও বাস্তবে এই গভর্নরদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশের ব্যাংকব্যবস্থা যখন ধ্বংসের প্রান্তে, তখন সেই ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারিগররা যদি আইনের বাইরে থাকেন, তাহলে জনগণের অর্থ নিরাপদ নয়। এই অবস্থা আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন