সত্যিই কি ইরানে ভূকম্পনের কারণ গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?

- Update Time : ১১:৪৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
- / ১০৩ Time View
ইসরায়েলের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি ও হামলা-পাল্টা হামলার প্রেক্ষাপটে ইরানের উত্তরাঞ্চলে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভূমিকম্পের মাত্রা ও অবস্থানকে কেন্দ্র করে এখন নানা জল্পনা-কল্পনা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার অন্যতম হলো— এই ভূমিকম্প প্রকৃতিপ্রসূত, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?
ভূমিকম্পের তথ্য ও অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানায়, শুক্রবার ইরানের সেমনান শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার (প্রায় ৬ মাইল)। সেমনান শহরটি রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ১৪৫ মাইল (২৩৩ কিলোমিটার) পূর্বে অবস্থিত। ভূকম্পনটি রাজধানী তেহরানসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়েছে।
এই ভূমিকম্পের একটি বিশেষ দিক হলো— এটি ইরানের কোম প্রদেশের কাছে অবস্থিত ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার নিকটবর্তী এলাকায় সংঘটিত হয়েছে। ফর্দো হলো ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরাপত্তা-ঘেরা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক নজরদারির আওতায় রয়েছে।
সন্দেহ ও গুজব
ভূমিকম্পটি এমন একটি সময় সংঘটিত হলো, যখন ইসরায়েলের সাথে ইরানের উত্তেজনা চরমে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় হামলা-পাল্টা হামলা, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে পারমাণবিক স্থাপনার পাশে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প স্বাভাবিক সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে যে, এটি হয়তো কোনো গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা ছিল, যা ভূমিকম্পের কারণ হয়ে থাকতে পারে। এক ইরানি ব্লগার তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে দাবি করেন, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (IRGC) কোনো রকম ‘নিউক্লিয়ার’ বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ভূকম্পনের সৃষ্টি করেছে। যদিও তাঁর এই দাবি নির্ভরযোগ্য উৎস দ্বারা নিশ্চিত হয়নি।
গণমাধ্যমের নীরবতা ও বিভ্রান্তি
ইরানের সরকারি বা বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো ভূমিকম্পের সংবাদ প্রকাশ করলেও সেখানে পারমাণবিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। বরং ভূমিকম্পের মাত্রা নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা গেছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ৫.১, কেউবা ৫.২, আবার কেউ ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের কথা বলেছে। এই ধরণের অসামঞ্জস্যতাও সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
তেহরানে বসবাসকারী একজন সাংবাদিক বলেন, “ভূমিকম্পের সময় কোনো রকম বিকট শব্দ বা বিস্ফোরণের ধ্বনি শোনা যায়নি। তবে ভূকম্পনের সময় মাটির কাঁপুনি বেশ তীব্র ছিল।” অন্যদিকে কিছু বাসিন্দা বলছেন, এটি ছিল হঠাৎ এবং স্থানীয় কিছু এলাকায় বাড়িঘরের জানালায় ফাটলও দেখা গেছে।
পারমাণবিক পরীক্ষায় ভূমিকম্প— সম্ভব কি?
ভূমিকম্প বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে ভূকম্পন সৃষ্টি সম্ভব। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এমনকি ভারত ও পাকিস্তানেও এমন পরীক্ষা হয়েছে, যার ফলে ভূমিকম্পের মতো কম্পন অনুভূত হয়েছে। পারমাণবিক বিস্ফোরণের সিগনেচার বা তরঙ্গের ধরন প্রাকৃতিক ভূমিকম্প থেকে ভিন্ন হয়, যা বিশেষ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ধরা পড়ে।
তবে ইরানের এই ভূমিকম্প প্রকৃতই ভূপ্রাকৃতিক কারণে হয়েছে, নাকি কোনো পরীক্ষার ফল— সেটি নির্ণয় করতে আন্তর্জাতিক ভূতাত্ত্বিক সংস্থাগুলোর দীর্ঘ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA), এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে IAEA এর একটি দল ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকে এবং তারা যদি কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়, তা হলে হয়তো শিগগিরই কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।
যদিও ইরানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরা হতে পারে, কিন্তু এর সময়কাল, অবস্থান এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ঘিরে নানা সন্দেহ ও গুজব দানা বাঁধছে। কোনো গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা এই ভূকম্পনের কারণ কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। তবে ঘটনাটি কেবল ভূতাত্ত্বিক নয়, বরং কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত গুরুত্বও বহন করছে। আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন ইরানের ওপর আরও নিবিড়ভাবে পড়বে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।
Please Share This Post in Your Social Media

সত্যিই কি ইরানে ভূকম্পনের কারণ গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?

ইসরায়েলের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি ও হামলা-পাল্টা হামলার প্রেক্ষাপটে ইরানের উত্তরাঞ্চলে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভূমিকম্পের মাত্রা ও অবস্থানকে কেন্দ্র করে এখন নানা জল্পনা-কল্পনা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার অন্যতম হলো— এই ভূমিকম্প প্রকৃতিপ্রসূত, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?
ভূমিকম্পের তথ্য ও অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানায়, শুক্রবার ইরানের সেমনান শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার (প্রায় ৬ মাইল)। সেমনান শহরটি রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ১৪৫ মাইল (২৩৩ কিলোমিটার) পূর্বে অবস্থিত। ভূকম্পনটি রাজধানী তেহরানসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়েছে।
এই ভূমিকম্পের একটি বিশেষ দিক হলো— এটি ইরানের কোম প্রদেশের কাছে অবস্থিত ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার নিকটবর্তী এলাকায় সংঘটিত হয়েছে। ফর্দো হলো ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরাপত্তা-ঘেরা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক নজরদারির আওতায় রয়েছে।
সন্দেহ ও গুজব
ভূমিকম্পটি এমন একটি সময় সংঘটিত হলো, যখন ইসরায়েলের সাথে ইরানের উত্তেজনা চরমে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় হামলা-পাল্টা হামলা, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে পারমাণবিক স্থাপনার পাশে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প স্বাভাবিক সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে যে, এটি হয়তো কোনো গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা ছিল, যা ভূমিকম্পের কারণ হয়ে থাকতে পারে। এক ইরানি ব্লগার তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে দাবি করেন, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (IRGC) কোনো রকম ‘নিউক্লিয়ার’ বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ভূকম্পনের সৃষ্টি করেছে। যদিও তাঁর এই দাবি নির্ভরযোগ্য উৎস দ্বারা নিশ্চিত হয়নি।
গণমাধ্যমের নীরবতা ও বিভ্রান্তি
ইরানের সরকারি বা বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো ভূমিকম্পের সংবাদ প্রকাশ করলেও সেখানে পারমাণবিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। বরং ভূমিকম্পের মাত্রা নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা গেছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ৫.১, কেউবা ৫.২, আবার কেউ ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের কথা বলেছে। এই ধরণের অসামঞ্জস্যতাও সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
তেহরানে বসবাসকারী একজন সাংবাদিক বলেন, “ভূমিকম্পের সময় কোনো রকম বিকট শব্দ বা বিস্ফোরণের ধ্বনি শোনা যায়নি। তবে ভূকম্পনের সময় মাটির কাঁপুনি বেশ তীব্র ছিল।” অন্যদিকে কিছু বাসিন্দা বলছেন, এটি ছিল হঠাৎ এবং স্থানীয় কিছু এলাকায় বাড়িঘরের জানালায় ফাটলও দেখা গেছে।
পারমাণবিক পরীক্ষায় ভূমিকম্প— সম্ভব কি?
ভূমিকম্প বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে ভূকম্পন সৃষ্টি সম্ভব। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এমনকি ভারত ও পাকিস্তানেও এমন পরীক্ষা হয়েছে, যার ফলে ভূমিকম্পের মতো কম্পন অনুভূত হয়েছে। পারমাণবিক বিস্ফোরণের সিগনেচার বা তরঙ্গের ধরন প্রাকৃতিক ভূমিকম্প থেকে ভিন্ন হয়, যা বিশেষ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ধরা পড়ে।
তবে ইরানের এই ভূমিকম্প প্রকৃতই ভূপ্রাকৃতিক কারণে হয়েছে, নাকি কোনো পরীক্ষার ফল— সেটি নির্ণয় করতে আন্তর্জাতিক ভূতাত্ত্বিক সংস্থাগুলোর দীর্ঘ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA), এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে IAEA এর একটি দল ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকে এবং তারা যদি কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়, তা হলে হয়তো শিগগিরই কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।
যদিও ইরানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরা হতে পারে, কিন্তু এর সময়কাল, অবস্থান এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ঘিরে নানা সন্দেহ ও গুজব দানা বাঁধছে। কোনো গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা এই ভূকম্পনের কারণ কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। তবে ঘটনাটি কেবল ভূতাত্ত্বিক নয়, বরং কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত গুরুত্বও বহন করছে। আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন ইরানের ওপর আরও নিবিড়ভাবে পড়বে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।