বিশ্ব অর্থনীতি চাপে, মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ

- Update Time : ১০:৪৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
- / ৭১ Time View

যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি বাজারের টালমাটাল অবস্থায় নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে
নতুন প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা ও জ্বালানি সংকট। এর মধ্যমণি হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে সংঘাত, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের উৎস ও মাত্রা
গত দুই বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলছে একপ্রকার স্থায়ী অর্থনৈতিক অস্থিরতা। করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, চীনের প্রবৃদ্ধি ধীরগতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতা বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর মধ্যে আফ্রিকার অনেক দেশ এবং লাতিন আমেরিকা প্রবল ঋণজালে আটকা পড়েছে, আবার ইউরোপে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে সাধারণ মানুষ তীব্র আর্থিক চাপ অনুভব করছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটে: জ্বালানি রাজনীতি ও যুদ্ধের প্রভাব
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক অঞ্চল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। কিন্তু আজ এই অঞ্চলটি যুদ্ধ, সংঘাত ও রাজনীতির বিস্ফোরক মঞ্চে রূপ নিয়েছে।
ইরান–ইসরায়েল সংঘাত
২০২৫ সালের শুরু থেকেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। পরমাণু কর্মসূচি, হিজবুল্লাহ, হুথি এবং হামাস নিয়ে একে অপরকে দায়ী করছে দুই দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি হামলায় ইরানি পরমাণু স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে তেহরান। পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরান হরমুজ প্রণালীতে নৌচলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছে।
এই পরিস্থিতি বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১২ মাসে ৬০ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ ডলারে, যা শিল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদন খরচ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর দেশগুলো যেমন—জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াও চাপে পড়েছে।
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর উদ্বেগ
সৌদি আরব, যাদের Vision 2030 প্রকল্প অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল, এখন সংকট মোকাবেলায় অপ্রস্তুত। পর্যটন, প্রযুক্তি, নির্মাণ খাতে বড় বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন ঝুঁকি বিবেচনা করছে।
অপরদিকে, ইয়েমেন, লেবানন, এবং সিরিয়া অর্থনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে। লেবাননের পাউন্ডের মান গত ১ বছরে ৯০ শতাংশের বেশি কমে গেছে, আর বেকারত্ব ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
প্রবাসী আয়ে ধাক্কা, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া বিপাকে
মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলোতে, যাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে প্রবাসীদের আয় কমেছে প্রায় ২০%। অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রায় ১৮% হ্রাস পেয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে এবং টাকার মান ডলারের বিপরীতে আরও দুর্বল হয়েছে।
বৈশ্বিক বাজারে মূল্যস্ফীতির রেকর্ড
মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়েছে খাদ্যপণ্যের বাজারেও। জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গম, চাল, চিনি, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগের তুলনায় ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর আর্থিক চাপ ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
সমাধানের পথ কী?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত দ্রুত সমাধান না হয়, তবে ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ব অর্থনীতি আরও গভীর মন্দায় নিমজ্জিত হতে পারে।
বিশ্ব নেতাদের কূটনৈতিক উদ্যোগ, অস্ত্র বিরতি এবং জাতিসংঘের নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাই এখন সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি, জ্বালানি বিকল্পে বিনিয়োগ, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতি এক চরম পরীক্ষার সময় পার করছে। আর এই সংকটের মূল কেন্দ্রস্থল এখন মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন শান্তি ও স্থিতিশীলতা—এই বার্তাই ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতি। না হলে মানবসভ্যতা আরও এক দীর্ঘমেয়াদী মন্দার দিকে এগিয়ে যাবে।
প্রতিবেদক: নতুন প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক
Please Share This Post in Your Social Media

বিশ্ব অর্থনীতি চাপে, মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ


যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি বাজারের টালমাটাল অবস্থায় নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে
নতুন প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা ও জ্বালানি সংকট। এর মধ্যমণি হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে সংঘাত, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের উৎস ও মাত্রা
গত দুই বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলছে একপ্রকার স্থায়ী অর্থনৈতিক অস্থিরতা। করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, চীনের প্রবৃদ্ধি ধীরগতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতা বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর মধ্যে আফ্রিকার অনেক দেশ এবং লাতিন আমেরিকা প্রবল ঋণজালে আটকা পড়েছে, আবার ইউরোপে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে সাধারণ মানুষ তীব্র আর্থিক চাপ অনুভব করছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটে: জ্বালানি রাজনীতি ও যুদ্ধের প্রভাব
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক অঞ্চল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। কিন্তু আজ এই অঞ্চলটি যুদ্ধ, সংঘাত ও রাজনীতির বিস্ফোরক মঞ্চে রূপ নিয়েছে।
ইরান–ইসরায়েল সংঘাত
২০২৫ সালের শুরু থেকেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। পরমাণু কর্মসূচি, হিজবুল্লাহ, হুথি এবং হামাস নিয়ে একে অপরকে দায়ী করছে দুই দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি হামলায় ইরানি পরমাণু স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে তেহরান। পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরান হরমুজ প্রণালীতে নৌচলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছে।
এই পরিস্থিতি বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১২ মাসে ৬০ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ ডলারে, যা শিল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদন খরচ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর দেশগুলো যেমন—জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াও চাপে পড়েছে।
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর উদ্বেগ
সৌদি আরব, যাদের Vision 2030 প্রকল্প অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল, এখন সংকট মোকাবেলায় অপ্রস্তুত। পর্যটন, প্রযুক্তি, নির্মাণ খাতে বড় বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন ঝুঁকি বিবেচনা করছে।
অপরদিকে, ইয়েমেন, লেবানন, এবং সিরিয়া অর্থনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে। লেবাননের পাউন্ডের মান গত ১ বছরে ৯০ শতাংশের বেশি কমে গেছে, আর বেকারত্ব ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
প্রবাসী আয়ে ধাক্কা, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া বিপাকে
মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলোতে, যাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে প্রবাসীদের আয় কমেছে প্রায় ২০%। অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রায় ১৮% হ্রাস পেয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে এবং টাকার মান ডলারের বিপরীতে আরও দুর্বল হয়েছে।
বৈশ্বিক বাজারে মূল্যস্ফীতির রেকর্ড
মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়েছে খাদ্যপণ্যের বাজারেও। জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গম, চাল, চিনি, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগের তুলনায় ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর আর্থিক চাপ ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
সমাধানের পথ কী?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত দ্রুত সমাধান না হয়, তবে ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ব অর্থনীতি আরও গভীর মন্দায় নিমজ্জিত হতে পারে।
বিশ্ব নেতাদের কূটনৈতিক উদ্যোগ, অস্ত্র বিরতি এবং জাতিসংঘের নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাই এখন সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি, জ্বালানি বিকল্পে বিনিয়োগ, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতি এক চরম পরীক্ষার সময় পার করছে। আর এই সংকটের মূল কেন্দ্রস্থল এখন মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন শান্তি ও স্থিতিশীলতা—এই বার্তাই ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতি। না হলে মানবসভ্যতা আরও এক দীর্ঘমেয়াদী মন্দার দিকে এগিয়ে যাবে।
প্রতিবেদক: নতুন প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক