ব্যাংক লুটের মহোৎসব: মালিকদের পেটে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা

- Update Time : ০৩:১৯:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫
- / ১৬৩ Time View
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ ভয়াবহ সংকটের মুখে। কারণ একটাই—কিছু প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক ও পরিচালকগোষ্ঠীর লাগামহীন লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নামমাত্র কাগজে-কলমে ঋণের নামে জনগণের আমানতের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবলমাত্র ব্যাংক পরিচালকদের দখলেই রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৪৪ শতাংশ।
ব্যবস্থার আড়ালে লুটপাট
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সরকার পরিবর্তনের আগে ব্যাংক পরিচালকদের একত্রীকৃত ঋণ ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সরকার পরিবর্তিত হওয়ার পর মাত্র চার মাসে পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ কমে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকায়।
তবে এই হ্রাস কিছুটা প্রতীকী। কারণ, ব্যাংকের পরিচালকগণ এখনও শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকেই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন, ফলে তাঁদের অনেক লুকায়িত ঋণ এখনও “পরিচালক ঋণ” হিসেবেই থেকে গেছে।
কীভাবে লুট হলো এই বিপুল অঙ্কের টাকা?
ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিচালকদের একে অপরের সঙ্গে গোপন সমঝোতা এবং দুর্বল আইনের সুযোগ নিয়েই এই লুটপাট সংঘটিত হয়েছে।
ব্যাংক পরিচালনায় নিয়োজিত অনেক মালিক ও তাদের ঘনিষ্ঠরা নিজেরা পরিচালনা বোর্ডে না থেকেও বেনামে ঋণ নিয়েছেন। পরিচালক পদ হারালে ঋণ সাধারণ গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত হয়—এই ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়েই চলেছে ঋণ স্থানান্তরের খেলা।
লুটপাটে শীর্ষ গ্রুপগুলো
নথিপত্র বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, লুটপাটে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী গ্রুপগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে:
- এস আলম গ্রুপ: ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা পরিচালকদের মাধ্যমে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
- নাসা গ্রুপ: তাদের অধীন এক্সিম ব্যাংক থেকে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
- বেক্সিমকো গ্রুপ: এই গ্রুপও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
- ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক: এখানে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
- সাউথইস্ট ব্যাংক: পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ৬ হাজার কোটিরও বেশি।
২০১৬ সালে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপের উত্থানের পর আট বছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রায় ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি।
সরকার পরিবর্তনের পর করণীয় ও পরিস্থিতি
সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় ১১টি প্রভাবশালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এতে শুধু ৪ মাসে পরিচালকদের ঋণ কমে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
তবে অনেকেই এখনও শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকেই গোপনে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “শুধু ৮টি ব্যাংকের পরিচালকরা মোট মূলধন দিয়েছেন ২,৪০০ কোটি টাকা, অথচ তাঁরা ঋণ নিয়েছেন ৪৫ হাজার কোটি টাকা! এটা দুর্নীতির সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র।”
আইন ছিল, প্রয়োগ ছিল না
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দেয় যে, একজন পরিচালক তাঁর ব্যাংক থেকে পরিশোধিত মূলধনের ৫০% এর বেশি ঋণ নিতে পারবেন না। কিন্তু এ আইন কার্যত অকার্যকর থেকে গেছে। কারণ, এই সীমা এড়িয়ে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলেমিশে গ্রুপভিত্তিক লেনদেন চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আগস্টের আগে কী ঘটেছে তা সবার জানা। এখন আমরা খাতটিকে পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কারে কাজ করছি।”
যা করতে হবে এখনই
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “পরিচালকেরা যদি ঋণ না শোধ করেন, তাহলে তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে তা বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া উচিত—even যদি সব টাকা না ওঠে, দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।”
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুস সাদাত জানিয়েছেন, “আমরা ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্ট ও অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছি। যাঁরা ঋণ শোধে রাজি, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করে দ্রুত আদায় শুরু করেছি।”
চূড়ান্ত উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি তদারকি, আইনি সংস্কার ও কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাত আরও গভীর সংকটে পড়বে। বর্তমানে অনুমান করা হচ্ছে, গোপন চুক্তি, নামে-বেনামে ঋণ এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের প্রভাবের কারণে প্রকৃত পরিচালক–সম্পর্কিত ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সুতরাং, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হলে এখনই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা, এবং দুর্নীতিবাজ ব্যাংক মালিকদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
না হলে—ব্যাংক থাকবে, আমানত থাকবে না। জনগণের টাকা পকেটস্থ করার এই দুঃসাহস আগামীতেও চলতেই থাকবে।
Please Share This Post in Your Social Media

ব্যাংক লুটের মহোৎসব: মালিকদের পেটে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ ভয়াবহ সংকটের মুখে। কারণ একটাই—কিছু প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক ও পরিচালকগোষ্ঠীর লাগামহীন লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নামমাত্র কাগজে-কলমে ঋণের নামে জনগণের আমানতের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবলমাত্র ব্যাংক পরিচালকদের দখলেই রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৪৪ শতাংশ।
ব্যবস্থার আড়ালে লুটপাট
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সরকার পরিবর্তনের আগে ব্যাংক পরিচালকদের একত্রীকৃত ঋণ ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সরকার পরিবর্তিত হওয়ার পর মাত্র চার মাসে পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ কমে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকায়।
তবে এই হ্রাস কিছুটা প্রতীকী। কারণ, ব্যাংকের পরিচালকগণ এখনও শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকেই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন, ফলে তাঁদের অনেক লুকায়িত ঋণ এখনও “পরিচালক ঋণ” হিসেবেই থেকে গেছে।
কীভাবে লুট হলো এই বিপুল অঙ্কের টাকা?
ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিচালকদের একে অপরের সঙ্গে গোপন সমঝোতা এবং দুর্বল আইনের সুযোগ নিয়েই এই লুটপাট সংঘটিত হয়েছে।
ব্যাংক পরিচালনায় নিয়োজিত অনেক মালিক ও তাদের ঘনিষ্ঠরা নিজেরা পরিচালনা বোর্ডে না থেকেও বেনামে ঋণ নিয়েছেন। পরিচালক পদ হারালে ঋণ সাধারণ গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত হয়—এই ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়েই চলেছে ঋণ স্থানান্তরের খেলা।
লুটপাটে শীর্ষ গ্রুপগুলো
নথিপত্র বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, লুটপাটে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী গ্রুপগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে:
- এস আলম গ্রুপ: ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা পরিচালকদের মাধ্যমে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
- নাসা গ্রুপ: তাদের অধীন এক্সিম ব্যাংক থেকে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
- বেক্সিমকো গ্রুপ: এই গ্রুপও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
- ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক: এখানে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
- সাউথইস্ট ব্যাংক: পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ৬ হাজার কোটিরও বেশি।
২০১৬ সালে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপের উত্থানের পর আট বছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রায় ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি।
সরকার পরিবর্তনের পর করণীয় ও পরিস্থিতি
সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় ১১টি প্রভাবশালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এতে শুধু ৪ মাসে পরিচালকদের ঋণ কমে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
তবে অনেকেই এখনও শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকেই গোপনে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “শুধু ৮টি ব্যাংকের পরিচালকরা মোট মূলধন দিয়েছেন ২,৪০০ কোটি টাকা, অথচ তাঁরা ঋণ নিয়েছেন ৪৫ হাজার কোটি টাকা! এটা দুর্নীতির সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র।”
আইন ছিল, প্রয়োগ ছিল না
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দেয় যে, একজন পরিচালক তাঁর ব্যাংক থেকে পরিশোধিত মূলধনের ৫০% এর বেশি ঋণ নিতে পারবেন না। কিন্তু এ আইন কার্যত অকার্যকর থেকে গেছে। কারণ, এই সীমা এড়িয়ে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলেমিশে গ্রুপভিত্তিক লেনদেন চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আগস্টের আগে কী ঘটেছে তা সবার জানা। এখন আমরা খাতটিকে পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কারে কাজ করছি।”
যা করতে হবে এখনই
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “পরিচালকেরা যদি ঋণ না শোধ করেন, তাহলে তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে তা বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া উচিত—even যদি সব টাকা না ওঠে, দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।”
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুস সাদাত জানিয়েছেন, “আমরা ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্ট ও অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছি। যাঁরা ঋণ শোধে রাজি, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করে দ্রুত আদায় শুরু করেছি।”
চূড়ান্ত উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি তদারকি, আইনি সংস্কার ও কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাত আরও গভীর সংকটে পড়বে। বর্তমানে অনুমান করা হচ্ছে, গোপন চুক্তি, নামে-বেনামে ঋণ এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের প্রভাবের কারণে প্রকৃত পরিচালক–সম্পর্কিত ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সুতরাং, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হলে এখনই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা, এবং দুর্নীতিবাজ ব্যাংক মালিকদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
না হলে—ব্যাংক থাকবে, আমানত থাকবে না। জনগণের টাকা পকেটস্থ করার এই দুঃসাহস আগামীতেও চলতেই থাকবে।