সময়: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

ভয়াবহ ঋণখেলাপির জালে ব্যাংক খাত: ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালো, এক বছরে বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ১২:২৩:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
  • / ৬৬ Time View

da5416455be2aa0703b01d54d91cca2e11cfb9ec843a475b

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

ভয়াবহ ঋণখেলাপির জালে ব্যাংক খাত: লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালো, এক বছরে বেড়েছে লাখ ৩৮ হাজার কোটি
সঞ্চিতি ঘাটতি ১.৭০ লাখ কোটি, ধ্বংসের মুখে জনগণের আমানত

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা)

বিষয়

মার্চ ২০২৫

মার্চ ২০২৪

বৃদ্ধি

বিতরণকৃত ঋণ মোট

১৭,৪১,৮২০

১৬,৪০,৭৬৫

১,০১,০৫৫

খেলাপি ঋণ

৪,২০,৩৩৫

১,৮২,২৯৫

২,৩৮,০৪০

খেলাপির হার

২৪.১৩%

১১.১১%

১৩.০২% পয়েন্ট

সঞ্চিতি ঘাটতি

(১,৭০,৬৫৫)

(২৬,৫৮৫)

(১,৪৪,০৭০)

বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকে খেলাপি ঋণের চিত্র

ব্যাংকের ধরন

খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা)

খেলাপির হার

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক

১,৪৬,৪০৭

৪৫.৭৯%

বেসরকারি ৪২ ব্যাংক

২,৪৬,১৯৫

২০.৩১%

বিদেশি ৯ ব্যাংক

৩,২৩৯

৭.৭০%

বিশেষায়িত ৩ ব্যাংক

৬,৪৯৪

১৪.৮৭%

উৎস: বাংলাদেশ ব্যাংক, মার্চ ২০২৫

 

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। যা গত বছরের মার্চে ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধি নিছক আর্থিক ব্যর্থতা নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, ও দীর্ঘমেয়াদি গাফিলতির প্রতিচ্ছবি।

খেলাপি ঋণের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর এটি ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তারা পেরেছে মাত্র ১ লাখ ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতকারীদের টাকাই এখন ঝুঁকির মুখে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে নতুন ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা। আগে এক বছর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো না, এখন তিন মাস বা ৯০ দিন অনাদায়ী থাকলেই শ্রেণীকরণ হচ্ছে। আবার দেশের বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক বা ব্যবসায়ী প্রভাবশালী গোষ্ঠী—তাদেরও অনেককে ঋণ শ্রেণীকরণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে হঠাৎ করে চিত্রটি আরও ভয়াবহভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এটি এখনও সম্পূর্ণ চিত্র নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর একাধিকবার বলেছেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত হার ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি, এমনকি ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশের ব্যাংক খাতের বড় অংশই গত ১৫ বছরে দুর্নীতি, রাজনৈতিক লুটপাট ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ছিল। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকোসহ কয়েকটি গ্রুপ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে গেছে, যার বড় অংশই এখন খেলাপি।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, সরকার ক্ষমতা হারানোর আগ মুহূর্তে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটিতে। একই সময়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়—অর্থাৎ হিসাব থেকে মুছে ফেলা হয় যাতে খেলাপি কম দেখায়। এ ছাড়াও লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের ১৪টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনেন। এরপরই ধীরে ধীরে ব্যাংকিং খাতের আসল চিত্র উন্মোচিত হতে শুরু করে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যার গড় হার ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক—এই ব্যাংকগুলো সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ৪২টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২০.১৬ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি নয়টি ব্যাংকে ৩ হাজার ২৩৯ কোটি এবং সরকারি বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সংকটও দিন দিন বাড়ছে। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে শতভাগ সঞ্চিতি রাখতে না পারায় ব্যাংকগুলো এখন মূলধন সংকটে পড়ছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। অনেকেই এখন আর বাংলাদেশি ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) নিতে চায় না। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সতর্ক করে বলেছেন, ‘সান্ত্বনা দিয়ে চলা যাবে না। এখন সময় গভর্ন্যান্সের—শতভাগ সুশাসন ছাড়া খেলাপি ঋণ রোধ করা অসম্ভব।’

সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দেশের ব্যাংকিং খাত আজ এক গভীর দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জনগণের সঞ্চিত অর্থ এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত ব্যবস্থা, প্রভাবশালী লুটেরাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা এবং ব্যাংক খাতে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। এ অবস্থায় কঠোর ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে বাংলাদেশকে এ দুঃসময় থেকে রক্ষা করতে।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

ভয়াবহ ঋণখেলাপির জালে ব্যাংক খাত: ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালো, এক বছরে বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি

Update Time : ১২:২৩:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

ভয়াবহ ঋণখেলাপির জালে ব্যাংক খাত: লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালো, এক বছরে বেড়েছে লাখ ৩৮ হাজার কোটি
সঞ্চিতি ঘাটতি ১.৭০ লাখ কোটি, ধ্বংসের মুখে জনগণের আমানত

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা)

বিষয়

মার্চ ২০২৫

মার্চ ২০২৪

বৃদ্ধি

বিতরণকৃত ঋণ মোট

১৭,৪১,৮২০

১৬,৪০,৭৬৫

১,০১,০৫৫

খেলাপি ঋণ

৪,২০,৩৩৫

১,৮২,২৯৫

২,৩৮,০৪০

খেলাপির হার

২৪.১৩%

১১.১১%

১৩.০২% পয়েন্ট

সঞ্চিতি ঘাটতি

(১,৭০,৬৫৫)

(২৬,৫৮৫)

(১,৪৪,০৭০)

বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকে খেলাপি ঋণের চিত্র

ব্যাংকের ধরন

খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা)

খেলাপির হার

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক

১,৪৬,৪০৭

৪৫.৭৯%

বেসরকারি ৪২ ব্যাংক

২,৪৬,১৯৫

২০.৩১%

বিদেশি ৯ ব্যাংক

৩,২৩৯

৭.৭০%

বিশেষায়িত ৩ ব্যাংক

৬,৪৯৪

১৪.৮৭%

উৎস: বাংলাদেশ ব্যাংক, মার্চ ২০২৫

 

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। যা গত বছরের মার্চে ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধি নিছক আর্থিক ব্যর্থতা নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, ও দীর্ঘমেয়াদি গাফিলতির প্রতিচ্ছবি।

খেলাপি ঋণের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর এটি ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তারা পেরেছে মাত্র ১ লাখ ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতকারীদের টাকাই এখন ঝুঁকির মুখে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে নতুন ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা। আগে এক বছর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো না, এখন তিন মাস বা ৯০ দিন অনাদায়ী থাকলেই শ্রেণীকরণ হচ্ছে। আবার দেশের বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক বা ব্যবসায়ী প্রভাবশালী গোষ্ঠী—তাদেরও অনেককে ঋণ শ্রেণীকরণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে হঠাৎ করে চিত্রটি আরও ভয়াবহভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এটি এখনও সম্পূর্ণ চিত্র নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর একাধিকবার বলেছেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত হার ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি, এমনকি ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশের ব্যাংক খাতের বড় অংশই গত ১৫ বছরে দুর্নীতি, রাজনৈতিক লুটপাট ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ছিল। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকোসহ কয়েকটি গ্রুপ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে গেছে, যার বড় অংশই এখন খেলাপি।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, সরকার ক্ষমতা হারানোর আগ মুহূর্তে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটিতে। একই সময়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়—অর্থাৎ হিসাব থেকে মুছে ফেলা হয় যাতে খেলাপি কম দেখায়। এ ছাড়াও লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের ১৪টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনেন। এরপরই ধীরে ধীরে ব্যাংকিং খাতের আসল চিত্র উন্মোচিত হতে শুরু করে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যার গড় হার ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক—এই ব্যাংকগুলো সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ৪২টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২০.১৬ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি নয়টি ব্যাংকে ৩ হাজার ২৩৯ কোটি এবং সরকারি বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সংকটও দিন দিন বাড়ছে। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে শতভাগ সঞ্চিতি রাখতে না পারায় ব্যাংকগুলো এখন মূলধন সংকটে পড়ছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। অনেকেই এখন আর বাংলাদেশি ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) নিতে চায় না। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সতর্ক করে বলেছেন, ‘সান্ত্বনা দিয়ে চলা যাবে না। এখন সময় গভর্ন্যান্সের—শতভাগ সুশাসন ছাড়া খেলাপি ঋণ রোধ করা অসম্ভব।’

সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দেশের ব্যাংকিং খাত আজ এক গভীর দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জনগণের সঞ্চিত অর্থ এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত ব্যবস্থা, প্রভাবশালী লুটেরাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা এবং ব্যাংক খাতে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। এ অবস্থায় কঠোর ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে বাংলাদেশকে এ দুঃসময় থেকে রক্ষা করতে।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share