আবার নাকি আম ও যায়, ছালা ও যায়

- Update Time : ১২:০২:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
- / ৫৩ Time View
নতুন প্রতিদিন প্রতিবেদক
বিদেশে পাচার হওয়া বাংলাদেশের বিপুল সম্পদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি লিটিগেশন ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ১০–১৩ জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত চার দিনের সরকারি সফরের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইন ও তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘ডিএলএ পাইপার’ আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ ঘোষণা দেন। বৈঠকে ওমনি ব্রিজওয়ে, বেঞ্চওয়াক ক্যাপিটাল, আলভারেজ অ্যান্ড মার্সাল, ইউনিটাস গ্লোবাল প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত লিটিগেশন ফান্ডিং সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে গোপনীয়তা চুক্তি (NDA) স্বাক্ষর করেন।
এই ফান্ডের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৩০টি বড় আন্তর্জাতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার মামলা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করা, যাতে বৈধ প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া বিপুল অর্থ ফিরিয়ে আনা যায়। গভর্নর মনসুর জানান, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের মতো প্রধান অর্থ পাচার গন্তব্যগুলোতে ‘স্পেশাল পারপাস ভেহিকল’ (SPV) গঠন করা হবে, যা মামলাগুলোর আইনি কাঠামো পরিচালনা করবে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বা প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে তহবিল ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এছাড়া, লিটিগেশন ফান্ডিং, প্রমাণ সংগ্রহ, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং জব্দকৃত সম্পদ হস্তান্তর—সবকিছুকে একটি একীভূত কাঠামোর আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় ১৭০ মিলিয়ন এবং বেক্সিমকো গ্রুপের শায়ান ও শাহরিয়ার রহমানের নামে থাকা প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো সরকারের উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক মহলে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ১১ জুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন লন্ডনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA)-এর সদরদপ্তর পরিদর্শন করেন এবং সম্পদ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত চলমান ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন। আন্তর্জাতিক সচিবালয় ফর রিকভারি অ্যান্ড রিটার্ন অব এসেটস (ISCCC) প্রধান ড্যানিয়েল মারফির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের টাস্কফোর্স ও ব্রিটিশ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়।
তবে বিশ্লেষক ও পেশাদার আইনবিদদের একাংশ এই উদ্যোগ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, এমন লিটিগেশন ফান্ডিংয়ে যতটা না অর্থ ফেরত আসে, তার চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়ে যায় আইনি ও পরিচালন ব্যয়ে। আন্তর্জাতিক লিটিগেশন ফান্ডিং সংস্থাগুলো সাধারণত সফল আদায়ের পর প্রাপ্ত সম্পদের একটি বড় অংশ ‘সার্ভিস ফি’ হিসেবে দাবি করে থাকে, যা অনেক সময় ৩০–৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে প্রকৃত লাভের পরিমাণ অনেকাংশেই কমে আসে। তদুপরি, SPV-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় যদি যথাযথ অডিট ব্যবস্থা, ফলাফলভিত্তিক সূচক ও সংসদীয় নজরদারি না থাকে, তাহলে এই অর্থ অপচয় হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিদেশি আদালতনির্ভর হওয়ায় এটি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। বিচারাধীন প্রতিটি মামলার পিছনে বিপুল সময় ও শ্রম ব্যয় হয়, তদুপরি রাজনৈতিক পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন কিংবা নীতিগত অস্বচ্ছতা থাকলে মামলা দীর্ঘায়িত হয় এবং আদায়ের আগেই উদ্যোগ থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমন বাস্তবতায় অনেকেই আশঙ্কা করছেন, শেষ পর্যন্ত এই ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেও যদি পর্যাপ্ত অর্থ ফেরত না আসে, তাহলে এটি হবে “আমও যায়, ছালাও যায়” জাতীয় এক হতাশাজনক উদ্যোগ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্পদ ফেরতের জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এমন উচ্চ-পর্যায়ের উদ্যোগ সফল করতে হলে নীতি, কাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা একসাথে লাগবে। ফান্ড ব্যবস্থাপনায় নিরপেক্ষ থার্ড পার্টি অডিট, নিয়মিত পারফরমেন্স মূল্যায়ন এবং পার্লামেন্টারি ওভারসাইট কমিটি গঠন এখনই প্রয়োজন, নতুবা এ ধরনের প্রকল্প জনআস্থা হারাবে। একইসঙ্গে, কোন কোন মামলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
সব মিলিয়ে, এই ১০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন দেশের সম্পদ পুনরুদ্ধারে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে—তবে তাতে চাই সততা, দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সম্মিলন। অন্যথায়, বিগত অনেক প্রকল্পের মতোই এটি হতে পারে একটি উচ্চমূল্যের অপচয়, যেখানে “ফান্ড গেল, তবু ফেরত এল না”—এই আক্ষেপই থেকে যাবে। এখন দেখার বিষয়—সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঝুঁকি বুঝে পরিকল্পনার বাস্তবায়নে কতটা দক্ষতা দেখাতে পারে। জনসাধারণের প্রত্যাশা স্পষ্ট—আসুক সম্পদ, না যাক আরেক দফা করদাতার টাকা।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রেস ব্রিফিং, লন্ডন গোলটেবিল সম্মেলন ২০২৫, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ।
Please Share This Post in Your Social Media

আবার নাকি আম ও যায়, ছালা ও যায়

নতুন প্রতিদিন প্রতিবেদক
বিদেশে পাচার হওয়া বাংলাদেশের বিপুল সম্পদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি লিটিগেশন ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ১০–১৩ জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত চার দিনের সরকারি সফরের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইন ও তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘ডিএলএ পাইপার’ আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ ঘোষণা দেন। বৈঠকে ওমনি ব্রিজওয়ে, বেঞ্চওয়াক ক্যাপিটাল, আলভারেজ অ্যান্ড মার্সাল, ইউনিটাস গ্লোবাল প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত লিটিগেশন ফান্ডিং সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে গোপনীয়তা চুক্তি (NDA) স্বাক্ষর করেন।
এই ফান্ডের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৩০টি বড় আন্তর্জাতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার মামলা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করা, যাতে বৈধ প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া বিপুল অর্থ ফিরিয়ে আনা যায়। গভর্নর মনসুর জানান, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের মতো প্রধান অর্থ পাচার গন্তব্যগুলোতে ‘স্পেশাল পারপাস ভেহিকল’ (SPV) গঠন করা হবে, যা মামলাগুলোর আইনি কাঠামো পরিচালনা করবে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বা প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে তহবিল ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এছাড়া, লিটিগেশন ফান্ডিং, প্রমাণ সংগ্রহ, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং জব্দকৃত সম্পদ হস্তান্তর—সবকিছুকে একটি একীভূত কাঠামোর আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় ১৭০ মিলিয়ন এবং বেক্সিমকো গ্রুপের শায়ান ও শাহরিয়ার রহমানের নামে থাকা প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো সরকারের উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক মহলে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ১১ জুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন লন্ডনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA)-এর সদরদপ্তর পরিদর্শন করেন এবং সম্পদ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত চলমান ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন। আন্তর্জাতিক সচিবালয় ফর রিকভারি অ্যান্ড রিটার্ন অব এসেটস (ISCCC) প্রধান ড্যানিয়েল মারফির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের টাস্কফোর্স ও ব্রিটিশ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়।
তবে বিশ্লেষক ও পেশাদার আইনবিদদের একাংশ এই উদ্যোগ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, এমন লিটিগেশন ফান্ডিংয়ে যতটা না অর্থ ফেরত আসে, তার চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়ে যায় আইনি ও পরিচালন ব্যয়ে। আন্তর্জাতিক লিটিগেশন ফান্ডিং সংস্থাগুলো সাধারণত সফল আদায়ের পর প্রাপ্ত সম্পদের একটি বড় অংশ ‘সার্ভিস ফি’ হিসেবে দাবি করে থাকে, যা অনেক সময় ৩০–৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে প্রকৃত লাভের পরিমাণ অনেকাংশেই কমে আসে। তদুপরি, SPV-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় যদি যথাযথ অডিট ব্যবস্থা, ফলাফলভিত্তিক সূচক ও সংসদীয় নজরদারি না থাকে, তাহলে এই অর্থ অপচয় হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিদেশি আদালতনির্ভর হওয়ায় এটি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। বিচারাধীন প্রতিটি মামলার পিছনে বিপুল সময় ও শ্রম ব্যয় হয়, তদুপরি রাজনৈতিক পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন কিংবা নীতিগত অস্বচ্ছতা থাকলে মামলা দীর্ঘায়িত হয় এবং আদায়ের আগেই উদ্যোগ থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমন বাস্তবতায় অনেকেই আশঙ্কা করছেন, শেষ পর্যন্ত এই ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেও যদি পর্যাপ্ত অর্থ ফেরত না আসে, তাহলে এটি হবে “আমও যায়, ছালাও যায়” জাতীয় এক হতাশাজনক উদ্যোগ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্পদ ফেরতের জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এমন উচ্চ-পর্যায়ের উদ্যোগ সফল করতে হলে নীতি, কাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা একসাথে লাগবে। ফান্ড ব্যবস্থাপনায় নিরপেক্ষ থার্ড পার্টি অডিট, নিয়মিত পারফরমেন্স মূল্যায়ন এবং পার্লামেন্টারি ওভারসাইট কমিটি গঠন এখনই প্রয়োজন, নতুবা এ ধরনের প্রকল্প জনআস্থা হারাবে। একইসঙ্গে, কোন কোন মামলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
সব মিলিয়ে, এই ১০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন দেশের সম্পদ পুনরুদ্ধারে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে—তবে তাতে চাই সততা, দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সম্মিলন। অন্যথায়, বিগত অনেক প্রকল্পের মতোই এটি হতে পারে একটি উচ্চমূল্যের অপচয়, যেখানে “ফান্ড গেল, তবু ফেরত এল না”—এই আক্ষেপই থেকে যাবে। এখন দেখার বিষয়—সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঝুঁকি বুঝে পরিকল্পনার বাস্তবায়নে কতটা দক্ষতা দেখাতে পারে। জনসাধারণের প্রত্যাশা স্পষ্ট—আসুক সম্পদ, না যাক আরেক দফা করদাতার টাকা।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রেস ব্রিফিং, লন্ডন গোলটেবিল সম্মেলন ২০২৫, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ।