আওয়ামী লীগ নেতা রিপন মধু ও যুবলীগ নেতা রাজিবুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জে গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টা ও সালিশে বর্বর হামলার অভিযোগ: আহত অন্তত ১০, অভিযুক্তরা পলাতক

- Update Time : ০৩:১৭:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫
- / ১০৮ Time View

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার শুয়াগ্রাম ইউনিয়নে এক গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় ডাকা সালিশ বৈঠক পরিণত হয় চরম সহিংসতায়। রোববার (৮ জুন) সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় থেকে হাতাহাতি, এরপর মারধর ছড়িয়ে পড়ে। এতে নারীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। গুরুতর আহত ছয়জন বর্তমানে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। বাকি আহতরা স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ধর্ষণচেষ্টার নির্মম বিবরণ
প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে উপজেলার একটি গ্রামে ঘটেছে নারকীয় এই ঘটনা। এক গৃহবধূর স্বামী সেদিন বাড়িতে না থাকায় গভীর রাতে সুযোগ নেয় এলাকারই দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি—স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য রিপন মধু ও যুবলীগ নেতা রাজিবুল বিশ্বাস। তারা মুখোশ পরে গৃহবধূর ঘরের বেড়া কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং তাকে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে হাত-পা বেঁধে ফেলে।
গৃহবধূ প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে একপর্যায়ে রিপন মধুর মুখোশ খুলে ফেলেন, ফলে তিনি তাকে চিনে ফেলেন। এই অবস্থায় দুই অভিযুক্ত ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরদিন সকালে এলাকায় এ ঘটনা জানাজানি হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
সালিশে বিচার নয়, বরং পাল্টা হামলা
ঘটনার তিনদিন পর রোববার সন্ধ্যায় শুয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় ইউপি সদস্য অমল মধুর আহ্বানে সালিশ বৈঠক বসে। ভুক্তভোগী পরিবার সেখানে উপস্থিত হয়ে বিচার দাবি করে। তবে সালিশে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে উপস্থিত লোকজন পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করেই রিপন মধু ও রাজিবুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে তাদের অনুসারীরা গৃহবধূ এবং তার পরিবারের উপর হামলা চালায়। বাঁশ, লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে মারধর চালানো হয়। এতে ভুক্তভোগী নারী, তার স্বামী এবং আরও অন্তত আটজন আহত হন। তাদের মধ্যে ওসমান শেখ (২৬), ইয়াদুল শেখ (২২), হাসিবুল শেখ (২৮), আলী শেখ (১৮) এবং হাকিম আলী শেখ (২৫) গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
অভিযুক্তরা পলাতক, পুলিশ বলছে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা
ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত রিপন মধু ও রাজিবুল বিশ্বাস পলাতক রয়েছেন। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের বিরুদ্ধে এখনো দৃশ্যমান কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী জানান, তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্থানীয় ইউপি সদস্য তাকে সামাজিকভাবে সালিশে মীমাংসার আশ্বাস দেন। অথচ সেই সালিশেই তারা হামলার শিকার হন। তার ভাষায়, “আমরা বিচার চাইতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে উল্টো পিটুনির শিকার হলাম। এই বিচার কি আমরা পাবো না?”
কোটালীপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, “ঘটনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা
এই ঘটনায় শুয়াগ্রাম ও আশপাশের গ্রামগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধর্ষণচেষ্টা ও প্রকাশ্য হামলার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাতেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
একজন প্রবীণ গ্রামবাসী বলেন, “এটা কোনো একক ঘটনা না। এমন ঘটনা ঘটলে বিচার হয় না বলেই অপরাধীরা আরও সাহস পায়। যদি এখন কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে আরও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে।”
মানবাধিকার সংগঠন ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ধর্ষণচেষ্টার মতো গুরুতর অপরাধ এবং তার বিচার চাওয়ার সালিশে উল্টো ভুক্তভোগী পক্ষকে মারধর করার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তারা অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত বিচার দাবি করেছেন।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন এবং অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Please Share This Post in Your Social Media

আওয়ামী লীগ নেতা রিপন মধু ও যুবলীগ নেতা রাজিবুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জে গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টা ও সালিশে বর্বর হামলার অভিযোগ: আহত অন্তত ১০, অভিযুক্তরা পলাতক


গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার শুয়াগ্রাম ইউনিয়নে এক গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় ডাকা সালিশ বৈঠক পরিণত হয় চরম সহিংসতায়। রোববার (৮ জুন) সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় থেকে হাতাহাতি, এরপর মারধর ছড়িয়ে পড়ে। এতে নারীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। গুরুতর আহত ছয়জন বর্তমানে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। বাকি আহতরা স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ধর্ষণচেষ্টার নির্মম বিবরণ
প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে উপজেলার একটি গ্রামে ঘটেছে নারকীয় এই ঘটনা। এক গৃহবধূর স্বামী সেদিন বাড়িতে না থাকায় গভীর রাতে সুযোগ নেয় এলাকারই দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি—স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য রিপন মধু ও যুবলীগ নেতা রাজিবুল বিশ্বাস। তারা মুখোশ পরে গৃহবধূর ঘরের বেড়া কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং তাকে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে হাত-পা বেঁধে ফেলে।
গৃহবধূ প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে একপর্যায়ে রিপন মধুর মুখোশ খুলে ফেলেন, ফলে তিনি তাকে চিনে ফেলেন। এই অবস্থায় দুই অভিযুক্ত ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরদিন সকালে এলাকায় এ ঘটনা জানাজানি হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
সালিশে বিচার নয়, বরং পাল্টা হামলা
ঘটনার তিনদিন পর রোববার সন্ধ্যায় শুয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় ইউপি সদস্য অমল মধুর আহ্বানে সালিশ বৈঠক বসে। ভুক্তভোগী পরিবার সেখানে উপস্থিত হয়ে বিচার দাবি করে। তবে সালিশে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে উপস্থিত লোকজন পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করেই রিপন মধু ও রাজিবুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে তাদের অনুসারীরা গৃহবধূ এবং তার পরিবারের উপর হামলা চালায়। বাঁশ, লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে মারধর চালানো হয়। এতে ভুক্তভোগী নারী, তার স্বামী এবং আরও অন্তত আটজন আহত হন। তাদের মধ্যে ওসমান শেখ (২৬), ইয়াদুল শেখ (২২), হাসিবুল শেখ (২৮), আলী শেখ (১৮) এবং হাকিম আলী শেখ (২৫) গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
অভিযুক্তরা পলাতক, পুলিশ বলছে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা
ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত রিপন মধু ও রাজিবুল বিশ্বাস পলাতক রয়েছেন। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের বিরুদ্ধে এখনো দৃশ্যমান কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী জানান, তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্থানীয় ইউপি সদস্য তাকে সামাজিকভাবে সালিশে মীমাংসার আশ্বাস দেন। অথচ সেই সালিশেই তারা হামলার শিকার হন। তার ভাষায়, “আমরা বিচার চাইতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে উল্টো পিটুনির শিকার হলাম। এই বিচার কি আমরা পাবো না?”
কোটালীপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, “ঘটনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা
এই ঘটনায় শুয়াগ্রাম ও আশপাশের গ্রামগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধর্ষণচেষ্টা ও প্রকাশ্য হামলার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাতেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
একজন প্রবীণ গ্রামবাসী বলেন, “এটা কোনো একক ঘটনা না। এমন ঘটনা ঘটলে বিচার হয় না বলেই অপরাধীরা আরও সাহস পায়। যদি এখন কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে আরও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে।”
মানবাধিকার সংগঠন ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ধর্ষণচেষ্টার মতো গুরুতর অপরাধ এবং তার বিচার চাওয়ার সালিশে উল্টো ভুক্তভোগী পক্ষকে মারধর করার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তারা অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত বিচার দাবি করেছেন।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন এবং অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।