শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: এক মহান দেশপ্রেমিক ও সময়োপযোগী রূপান্তরের প্রতীক

- Update Time : ০২:১১:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
- / ১২৪ Time View
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যাঁরা তাঁদের কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েই নয়, বরং সময়োপযোগী চিন্তা, সাহসিকতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়ে জাতিকে এক নতুন গতিপথে পরিচালিত করেছেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (১৯৩৬–১৯৮১) ছিলেন তেমনই একজন মহান নেতা, যিনি তাঁর সামরিক অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রনায়কসুলভ দূরদৃষ্টি এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশে একটি ঐতিহাসিক মোড় এনে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তাঁর চিন্তাধারা ছিল অত্যন্ত প্রগতিশীল, বাস্তবভিত্তিক এবং দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তিনি এমন একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং জাতীয় ঐক্য সমভাবে গুরুত্ব পাবে।
জন্ম, শৈশব ও দেশপ্রেমের বীজ
জিয়াউর রহমানের জন্ম হয় ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ী গ্রামে। তাঁর পিতা মনসুর রহমান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, যার চাকরি তাঁকে বিভিন্ন জেলায় স্থানান্তরিত করত। এই কারণে জিয়ার শৈশব কাটে নানা জায়গায়—যা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে বিস্তৃত করেছিল। মা জাহানারা খাতুন ছিলেন এক আদর্শ মমতাময়ী মা, যিনি শিশু জিয়ার চরিত্রে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম ও নৈতিকতা গেঁথে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও আত্মপ্রত্যয়ী। দেশ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ, মানুষের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি, এবং নেতৃত্বদানের সহজাত গুণ তাকে পরবর্তী সময়ে দেশের এক মহান রূপান্তরকর্তায় পরিণত করে। তাঁর শৈশব থেকেই যে দেশপ্রেমের বীজ রোপিত হয়েছিল, তা সময়ের পরিক্রমায় এক অটল বটবৃক্ষে পরিণত হয়।
সেনানায়ক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক
জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় অফিসার, যিনি শৃঙ্খলা, সাহস এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে সহকর্মীদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে “হিলাল-ই-জুরাত” পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, যা ছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান। কিন্তু জাতি তাঁকে সবচেয়ে বেশি মনে রাখে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর সমগ্র জাতি এক অনিশ্চয়তায় ডুবে ছিল। ঠিক তখনই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন—”আমি মেজর জিয়া বলছি, আমি বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণাই জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধকে কার্যকরভাবে শুরু করার অনুপ্রেরণা জোগায়।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক
স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা যায়, জাতি আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতে ভুগছে। জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্নে নানা মতবিরোধ তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান জাতীয় পরিচয়ের একটি নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন—”বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”। এই দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং জনগণের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। তিনি মনে করতেন, একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হতে হবে সেই রাষ্ট্রের জনগণ, তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ছিল একটি বাস্তবভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় দর্শন, যা সকল ধর্ম, বর্ণ, ভাষার মানুষকে একত্রিত করার শক্তি জোগায় এবং বাংলাদেশি পরিচয়কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুদৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করে।
কৃষক–দরদী উন্নয়নবিষয়ক রাষ্ট্রনায়ক
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ একটি চরম খাদ্য সংকটে পড়ে। কৃষি খাত ছিল অকার্যকর ও প্রযুক্তিহীন। এই সময় শহীদ জিয়াউর রহমান কৃষিকে জাতীয় উন্নয়নের মেরুদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি সরাসরি মাঠে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলেন, তাদের প্রয়োজন বোঝেন এবং তা পূরণে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে কৃষকদের জন্য ১০০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বরাদ্দ করা হয়, দেশব্যাপী খাল খননের প্রকল্প চালু হয়, গভীর নলকূপ বিতরণ করা হয় এবং সেচ ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনা হয়। নিজ হাতে কোদাল দিয়ে খাল কাটার ছবি বাংলাদেশে এক অমর চিত্র হয়ে আছে, যা তাঁর কৃষকদরদী মনোভাব ও নেতৃত্বের অনন্য উদাহরণ।
শিক্ষানুরাগী সংস্কারক
শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন, একটি জাতির উন্নতির মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। তিনি শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই নয়, বরং কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দেন। তাঁর সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন এবং গ্রামে-গঞ্জে নতুন স্কুল, কলেজ এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে তিনি নানা প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা নীতিতে আত্মনির্ভরতা, কর্মমুখী শিক্ষা এবং বাস্তব জ্ঞানার্জনের উপর গুরুত্ব ছিল। এই নীতির মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি সমাজ গড়তে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক হবে দক্ষ, চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল।
সার্কের প্রস্তাবক
আন্তর্জাতিক পরিসরে জিয়াউর রহমান ছিলেন এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে “সার্ক” প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শিক্ষাসহ নানা সমস্যা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। তাঁর এই ভাবনা আজ বাস্তবতা হয়েছে—”সার্ক” এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সহযোগিতা সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। এই প্রস্তাবনা ছিল তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত, যা আজও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্মরণীয়।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থপতি
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ একদলীয় শাসনের চাপে দমবন্ধ হয়ে পড়েছিল। বাকশাল প্রতিষ্ঠার ফলে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিরোধী দলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণের মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক নির্বাচনের স্বাধীনতাই একটি টেকসই রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি। তাঁর নেতৃত্বে দেশে রাজনৈতিক pluralism ফিরে আসে এবং একাধিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। এভাবেই তিনি গণতন্ত্রের পথে জাতিকে ফিরিয়ে আনেন।
১৯ দফা কর্মসূচি: দেশ গঠনের রূপরেখা
শহীদ জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। এই কর্মসূচিতে ছিল খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, স্বনির্ভর অর্থনীতি, কৃষি ও শিল্পোন্নয়ন, শিক্ষা সংস্কার, প্রশাসনিক দুর্নীতির অবসান এবং একটি কার্যকর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ন্যায্যতা, দক্ষ জনশক্তি গঠন এবং জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই কর্মসূচি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘোষণা ছিল না, বরং একটি বাস্তবায়নযোগ্য উন্নয়ন দর্শন ছিল, যার প্রতিটি দিক বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল।
একটি আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা
জিয়াউর রহমানের চিন্তা ছিল শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে দেওয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ একটি মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে—যদি তার নেতৃত্ব হয় সৎ, চিন্তাশীল এবং দূরদর্শী। তিনি বলতেন, “আমরা কেউ গরিব হতে আসিনি, আমরা এসেছি নিজেদের ভাগ্য গড়তে।” এই চিন্তা থেকেই তিনি জাতীয় ঐক্য, আত্মনির্ভরতা, এবং বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর এই ভাবনা আজও জাতির জন্য একটি প্রেরণাদায়ী বার্তা।
শহীদ হয়েও অমর
১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রামে এক অভ্যুত্থানকালে শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁকে হত্যা করা হলেও, তাঁর আদর্শ ও কাজের মাধ্যমে তিনি আজও জীবিত আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। তাঁর প্রবর্তিত নীতিমালা, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক সংস্কার আজও বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি ও উন্নয়ন দর্শনের অংশ। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেমন একটি সাহসী নেতৃত্বের অবসান ঘটে, তেমনি জন্ম হয় এক অমর আদর্শের—যা প্রতিনিয়ত দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রেরণা জোগায়।
শেষকথা বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বিরল নেতা—যিনি একজন দক্ষ সেনানায়ক থেকে হয়ে উঠেছেন এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি প্রমাণ করেছেন, দেশপ্রেম কেবল আবেগ নয়, বরং তা বাস্তবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাঁর চিন্তা, কর্ম এবং আত্মত্যাগ আজও এই দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। ভবিষ্যতের বাংলাদেশের পথনির্দেশক হিসেবে শহীদ জিয়াউর রহমান আজও অমর, তাঁর আত্মত্যাগ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শহীদ জিয়াউর রহমান কেবল একজন নেতা নন—তিনি ছিলেন বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের স্থপতি, একজন মহান রূপান্তরকারী এবং সত্যিকার দেশপ্রেমিক।
Please Share This Post in Your Social Media

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: এক মহান দেশপ্রেমিক ও সময়োপযোগী রূপান্তরের প্রতীক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যাঁরা তাঁদের কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েই নয়, বরং সময়োপযোগী চিন্তা, সাহসিকতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়ে জাতিকে এক নতুন গতিপথে পরিচালিত করেছেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (১৯৩৬–১৯৮১) ছিলেন তেমনই একজন মহান নেতা, যিনি তাঁর সামরিক অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রনায়কসুলভ দূরদৃষ্টি এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশে একটি ঐতিহাসিক মোড় এনে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তাঁর চিন্তাধারা ছিল অত্যন্ত প্রগতিশীল, বাস্তবভিত্তিক এবং দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তিনি এমন একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং জাতীয় ঐক্য সমভাবে গুরুত্ব পাবে।
জন্ম, শৈশব ও দেশপ্রেমের বীজ
জিয়াউর রহমানের জন্ম হয় ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ী গ্রামে। তাঁর পিতা মনসুর রহমান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, যার চাকরি তাঁকে বিভিন্ন জেলায় স্থানান্তরিত করত। এই কারণে জিয়ার শৈশব কাটে নানা জায়গায়—যা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে বিস্তৃত করেছিল। মা জাহানারা খাতুন ছিলেন এক আদর্শ মমতাময়ী মা, যিনি শিশু জিয়ার চরিত্রে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম ও নৈতিকতা গেঁথে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও আত্মপ্রত্যয়ী। দেশ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ, মানুষের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি, এবং নেতৃত্বদানের সহজাত গুণ তাকে পরবর্তী সময়ে দেশের এক মহান রূপান্তরকর্তায় পরিণত করে। তাঁর শৈশব থেকেই যে দেশপ্রেমের বীজ রোপিত হয়েছিল, তা সময়ের পরিক্রমায় এক অটল বটবৃক্ষে পরিণত হয়।
সেনানায়ক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক
জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় অফিসার, যিনি শৃঙ্খলা, সাহস এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে সহকর্মীদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে “হিলাল-ই-জুরাত” পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, যা ছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান। কিন্তু জাতি তাঁকে সবচেয়ে বেশি মনে রাখে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর সমগ্র জাতি এক অনিশ্চয়তায় ডুবে ছিল। ঠিক তখনই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন—”আমি মেজর জিয়া বলছি, আমি বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণাই জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধকে কার্যকরভাবে শুরু করার অনুপ্রেরণা জোগায়।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক
স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা যায়, জাতি আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতে ভুগছে। জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্নে নানা মতবিরোধ তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান জাতীয় পরিচয়ের একটি নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন—”বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”। এই দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং জনগণের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। তিনি মনে করতেন, একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হতে হবে সেই রাষ্ট্রের জনগণ, তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ছিল একটি বাস্তবভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় দর্শন, যা সকল ধর্ম, বর্ণ, ভাষার মানুষকে একত্রিত করার শক্তি জোগায় এবং বাংলাদেশি পরিচয়কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুদৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করে।
কৃষক–দরদী উন্নয়নবিষয়ক রাষ্ট্রনায়ক
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ একটি চরম খাদ্য সংকটে পড়ে। কৃষি খাত ছিল অকার্যকর ও প্রযুক্তিহীন। এই সময় শহীদ জিয়াউর রহমান কৃষিকে জাতীয় উন্নয়নের মেরুদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি সরাসরি মাঠে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলেন, তাদের প্রয়োজন বোঝেন এবং তা পূরণে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে কৃষকদের জন্য ১০০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বরাদ্দ করা হয়, দেশব্যাপী খাল খননের প্রকল্প চালু হয়, গভীর নলকূপ বিতরণ করা হয় এবং সেচ ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনা হয়। নিজ হাতে কোদাল দিয়ে খাল কাটার ছবি বাংলাদেশে এক অমর চিত্র হয়ে আছে, যা তাঁর কৃষকদরদী মনোভাব ও নেতৃত্বের অনন্য উদাহরণ।
শিক্ষানুরাগী সংস্কারক
শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন, একটি জাতির উন্নতির মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। তিনি শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই নয়, বরং কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দেন। তাঁর সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন এবং গ্রামে-গঞ্জে নতুন স্কুল, কলেজ এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে তিনি নানা প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা নীতিতে আত্মনির্ভরতা, কর্মমুখী শিক্ষা এবং বাস্তব জ্ঞানার্জনের উপর গুরুত্ব ছিল। এই নীতির মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি সমাজ গড়তে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক হবে দক্ষ, চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল।
সার্কের প্রস্তাবক
আন্তর্জাতিক পরিসরে জিয়াউর রহমান ছিলেন এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে “সার্ক” প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শিক্ষাসহ নানা সমস্যা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। তাঁর এই ভাবনা আজ বাস্তবতা হয়েছে—”সার্ক” এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সহযোগিতা সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। এই প্রস্তাবনা ছিল তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত, যা আজও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্মরণীয়।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থপতি
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ একদলীয় শাসনের চাপে দমবন্ধ হয়ে পড়েছিল। বাকশাল প্রতিষ্ঠার ফলে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিরোধী দলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণের মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক নির্বাচনের স্বাধীনতাই একটি টেকসই রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি। তাঁর নেতৃত্বে দেশে রাজনৈতিক pluralism ফিরে আসে এবং একাধিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। এভাবেই তিনি গণতন্ত্রের পথে জাতিকে ফিরিয়ে আনেন।
১৯ দফা কর্মসূচি: দেশ গঠনের রূপরেখা
শহীদ জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। এই কর্মসূচিতে ছিল খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, স্বনির্ভর অর্থনীতি, কৃষি ও শিল্পোন্নয়ন, শিক্ষা সংস্কার, প্রশাসনিক দুর্নীতির অবসান এবং একটি কার্যকর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ন্যায্যতা, দক্ষ জনশক্তি গঠন এবং জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই কর্মসূচি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘোষণা ছিল না, বরং একটি বাস্তবায়নযোগ্য উন্নয়ন দর্শন ছিল, যার প্রতিটি দিক বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল।
একটি আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা
জিয়াউর রহমানের চিন্তা ছিল শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে দেওয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ একটি মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে—যদি তার নেতৃত্ব হয় সৎ, চিন্তাশীল এবং দূরদর্শী। তিনি বলতেন, “আমরা কেউ গরিব হতে আসিনি, আমরা এসেছি নিজেদের ভাগ্য গড়তে।” এই চিন্তা থেকেই তিনি জাতীয় ঐক্য, আত্মনির্ভরতা, এবং বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর এই ভাবনা আজও জাতির জন্য একটি প্রেরণাদায়ী বার্তা।
শহীদ হয়েও অমর
১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রামে এক অভ্যুত্থানকালে শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁকে হত্যা করা হলেও, তাঁর আদর্শ ও কাজের মাধ্যমে তিনি আজও জীবিত আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। তাঁর প্রবর্তিত নীতিমালা, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক সংস্কার আজও বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি ও উন্নয়ন দর্শনের অংশ। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেমন একটি সাহসী নেতৃত্বের অবসান ঘটে, তেমনি জন্ম হয় এক অমর আদর্শের—যা প্রতিনিয়ত দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রেরণা জোগায়।
শেষকথা বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বিরল নেতা—যিনি একজন দক্ষ সেনানায়ক থেকে হয়ে উঠেছেন এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি প্রমাণ করেছেন, দেশপ্রেম কেবল আবেগ নয়, বরং তা বাস্তবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাঁর চিন্তা, কর্ম এবং আত্মত্যাগ আজও এই দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। ভবিষ্যতের বাংলাদেশের পথনির্দেশক হিসেবে শহীদ জিয়াউর রহমান আজও অমর, তাঁর আত্মত্যাগ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শহীদ জিয়াউর রহমান কেবল একজন নেতা নন—তিনি ছিলেন বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের স্থপতি, একজন মহান রূপান্তরকারী এবং সত্যিকার দেশপ্রেমিক।