সময়: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

টানা ১০ দিনের ছুটি: ঈদের আনন্দ না রাষ্ট্রের আত্মঘাতী স্থবিরতা?

বিল্লাল হোসেন
  • Update Time : ০১:০২:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
  • / ১৭১ Time View

eiduladha 10 day holiday

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

eiduladha 10 day holiday

বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে টানা ১০ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণাকে ঘিরে দেশের সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে এক গভীর আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি একদিকে জনগণের জীবনে সাময়িক স্বস্তি আনলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি রাষ্ট্র পরিচালনার গতি ও জনজীবনের মৌলিক অধিকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশ্ন উঠেছে এই ছুটি কি কেবল উৎসবের আমেজ, না কি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার একটি গা-সওয়া রূপ?

ছুটি: উৎসব না পালানোর উপায়?

ঈদ উপলক্ষে ছুটি প্রথাগতভাবে বাংলাদেশে ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে ছুটির দিন সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি স্বেচ্ছায় ছুটি নিয়ে এই ছুটিকে ১০ দিনের মতো টেনে নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ২-৩ দিন ‘সংযুক্ত ছুটি’ (sandwich leave) দেওয়া হয়, যা কার্যত অফিস-আদালতকে এক সপ্তাহের বেশি স্থবির করে রাখে।

এই প্রক্রিয়াটিকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন “Institutional Laziness”—অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠান তার কার্যকারিতাকে সচেতনভাবে অকার্যকর করে তুলছে। এ প্রবণতা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা, যেখানে ছুটি যেন রাষ্ট্রের কর্মক্ষমতার প্রতিস্থাপক রূপে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত

বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে দীর্ঘ ছুটি দেয়ার সংস্কৃতি নেই। উদাহরণস্বরূপ:

  • মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া: ঈদের জন্য সর্বোচ্চ ২-৩ দিনের ছুটি দেওয়া হয়। কর্মজীবীরা উৎসবের পরদিনই কর্মস্থলে ফিরে যান।
  • ভারত: বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও ঈদের জন্য ১ দিনের ছুটি নির্ধারিত। অনেকক্ষেত্রে সরকারি অফিস আগেরদিন অর্ধদিবস খোলা থাকে।
  • সৌদি আরব: এখানে ঈদুল ফিতরের জন্য ৪ দিন এবং ঈদুল আযহার জন্য ৫ দিনের সরকারি ছুটি দেওয়া হয়, তবে জরুরি পরিষেবা চালু থাকে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে সরকার টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করে, যা অর্থনীতিবিদদের মতে জিডিপির প্রায় ০.৩% হ্রাসের কারণ হতে পারে। (সূত্র: CPD ও অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

দিনমজুর নিম্নবিত্তের ওপর নির্মম চাপ

ঈদের ছুটির প্রভাব সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি—দিনমজুর, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ে। তারা প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যখন একটানা ছুটি চলে, তখন তাদের আয়ের উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জরিপ অনুযায়ী, ঈদ উপলক্ষে ৭০% দিনমজুরকে ঋণ করতে হয় পরিবারকে খাবার খাওয়াতে। (সূত্র: বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক, ২০২৩)

ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা ব্যাংকিং বিপর্যয়

এই ছুটির ফলে:

  • ব্যাংক বন্ধ: ঋণ নিষ্পত্তি, LC ক্লিয়ারেন্স, টাকা উত্তোলন, ATM রিফিল প্রক্রিয়া পর্যন্ত স্থবির হয়ে পড়ে।
  • আমদানিরপ্তানি বিলম্বিত: চট্টগ্রাম ও বেনাপোল বন্দরে পণ্যের কন্টেইনার জমে যায়। এতে করে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (সূত্র: বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)
  • শেয়ার বাজার: ১০ দিনের ছুটিতে শেয়ারবাজার কার্যত স্থবির, বিনিয়োগকারীদের হাতে নগদ অর্থ আটকে যায়।

জরুরি সেবা: ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত জনগণ

ঈদের ছুটিতে সরকারি হাসপাতালগুলো ‘অপারেশন ছাড়া কোনো পরিষেবা’ দেয় না বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। আদালত বন্ধ থাকায় জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ছুটি শেষে ছাড়া হয়, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। জরুরি প্রয়োজনে প্রশাসনিক সাড়া না পাওয়া নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ভেঙে দেয়।

রাষ্ট্র কি শিশুর মতো বিশ্রাম চায়?

রাষ্ট্র কোনো শিশুর মতো নয় যে তাকে ছুটি দিয়ে বিশ্রাম দিতে হবে। বরং রাষ্ট্র একটি চিরসচল মেশিন—যে মেশিন থেমে গেলে নাগরিকদের জীবনও থেমে যায়। যেমন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছিলেন, “The state is not a mechanical entity; it is a regulatory framework of life.” রাষ্ট্রের প্রতিটি মিনিট জনগণের কল্যাণে উৎসর্গিত হওয়া উচিত।

রাষ্ট্রীয় দর্শন দায়িত্বচ্যুতি

রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মনে থাকা উচিত, রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে একটি নৈতিক দায়িত্ব জড়িত। হান্না আরেন্ট যেমন বলেছিলেন: “The banality of irresponsibility is more dangerous than evil itself.” ছুটির নামে রাষ্ট্র তার কর্তব্যচ্যুতি ও দায়িত্বহীনতাকে বৈধতা দিচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য মারাত্মক।

ধর্মীয় বৈষম্য বৈষম্যমূলক নীতির সম্ভাবনা

যদি ঈদ উপলক্ষে ১০ দিনের ছুটি হয়, তাহলে দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা—এই ধর্মীয় উৎসবগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় এটি সংবিধানের ২৮(১) ধারা লঙ্ঘন করে, যেখানে বলা হয়েছে—“রাষ্ট্র কোনো ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির প্রতি বৈষম্য করবে না।” সংবিধানিক বৈষম্য রাষ্ট্রের সামাজিক শৃঙ্খলা ও সহনশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

প্রশাসনিক স্থবিরতা নাগরিকের আস্থাহীনতা

টানা ছুটির ফলে সাধারণ নাগরিক প্রতিদিনের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়:

  • দলিল নিবন্ধন ও ভূমি অফিসে ফাইল আটকে থাকে।
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে।
  • কোর্টের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিচার প্রার্থীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।

এভাবে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থা নষ্ট হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে।

করণীয়: নীতিগত ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ

সরকারের উচিত এ ধরনের ছুটির সংস্কৃতি পুনর্বিবেচনা করা। ছুটি হোক উৎসবের অভিব্যক্তি, কিন্তু তা যেন কখনো রাষ্ট্রের অচলাবস্থার প্রতীক না হয়। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে ‘রোটেশন সিস্টেমে’ দায়িত্ব পালনকারী কর্মী রাখা যেতে পারে। জরুরি সেবার মতো প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ভিন্ন নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।

উল্লেখযোগ্যভাবে, জাপানে ‘Golden Week’-এর সময় সরকার একটি “কেনাকাটার গাইড” ও জরুরি সেবা রুটিন প্রকাশ করে। আমরাও চাইলে বাংলাদেশে এর অনুকরণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ছুটির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি।

ছুটির নামে পলায়ন নয়, রাষ্ট্রচিন্তার জাগরণ হোক মূলমন্ত্র

রাষ্ট্র শুধুমাত্র উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করতে পারে না। তাকে প্রতিনিয়ত জনগণের সেবা দিতে হয়। টানা ছুটি প্রশাসনিক অক্ষমতা, দায়িত্বচ্যুতি ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি। ঈদের আনন্দ হোক উদযাপনের উপলক্ষ, কিন্তু রাষ্ট্র যেন তার চিরসচলতা, দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে।

এভাবে ঈদের আনন্দ যেন রাষ্ট্রের স্থবিরতার বিনিময়ে অর্জিত না হয়—এই হোক চেতনার প্রেরণা।

 

তথ্যসূত্র:

  1. CPD Annual Economic Review, 2024
  2. Hannah Arendt, The Human Condition, 1958
  3. Michel Foucault, Society Must Be Defended, 1975
  4. BRAC Humanitarian Research, 2023
  5. Constitution of Bangladesh, Article 28
  6. Business Standard Bangladesh, Eid Supply Chain Analysis, 2023

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
About Author Information

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন, একজন প্রজ্ঞাবান পেশাজীবী, যিনি গণিতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। তার আর্থিক খাতে যাত্রা তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকিং Inc. এবং ব্যাংক-আল-বিলাদে বিদেশী সম্পর্ক ও করেসপন্ডেন্ট মেইন্টেনেন্স অফিসার হিসেবে। প্রথাগত অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে, বিল্লাল একজন প্রখ্যাত লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে মননশীল কলাম ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। তার দক্ষতা বিস্তৃত বিষয় জুড়ে রয়েছে, যেমন অর্থনীতির জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, রেমিটেন্স, রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত দিক। বিল্লাল তার লেখায় একটি অনন্য বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে একত্রিত করে একাডেমিক কঠোরতার সাথে। তার প্রবন্ধগুলো শুধুমাত্র জটিল বিষয়গুলির উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন নয়, বরং পাঠকদের জন্য জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। বিল্লাল হোসেনের অবদান তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে, তিনি আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জটিলতাগুলি উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিস্তৃত এবং আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার দিকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

টানা ১০ দিনের ছুটি: ঈদের আনন্দ না রাষ্ট্রের আত্মঘাতী স্থবিরতা?

Update Time : ০১:০২:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

eiduladha 10 day holiday

বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে টানা ১০ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণাকে ঘিরে দেশের সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে এক গভীর আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি একদিকে জনগণের জীবনে সাময়িক স্বস্তি আনলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি রাষ্ট্র পরিচালনার গতি ও জনজীবনের মৌলিক অধিকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশ্ন উঠেছে এই ছুটি কি কেবল উৎসবের আমেজ, না কি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার একটি গা-সওয়া রূপ?

ছুটি: উৎসব না পালানোর উপায়?

ঈদ উপলক্ষে ছুটি প্রথাগতভাবে বাংলাদেশে ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে ছুটির দিন সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি স্বেচ্ছায় ছুটি নিয়ে এই ছুটিকে ১০ দিনের মতো টেনে নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ২-৩ দিন ‘সংযুক্ত ছুটি’ (sandwich leave) দেওয়া হয়, যা কার্যত অফিস-আদালতকে এক সপ্তাহের বেশি স্থবির করে রাখে।

এই প্রক্রিয়াটিকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন “Institutional Laziness”—অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠান তার কার্যকারিতাকে সচেতনভাবে অকার্যকর করে তুলছে। এ প্রবণতা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা, যেখানে ছুটি যেন রাষ্ট্রের কর্মক্ষমতার প্রতিস্থাপক রূপে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: নজিরবিহীন

সিদ্ধান্ত

বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে দীর্ঘ ছুটি দেয়ার সংস্কৃতি নেই। উদাহরণস্বরূপ:

  • মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া: ঈদের জন্য সর্বোচ্চ ২-৩ দিনের ছুটি দেওয়া হয়। কর্মজীবীরা উৎসবের পরদিনই কর্মস্থলে ফিরে যান।
  • ভারত: বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও ঈদের জন্য ১ দিনের ছুটি নির্ধারিত। অনেকক্ষেত্রে সরকারি অফিস আগেরদিন অর্ধদিবস খোলা থাকে।
  • সৌদি আরব: এখানে ঈদুল ফিতরের জন্য ৪ দিন এবং ঈদুল আযহার জন্য ৫ দিনের সরকারি ছুটি দেওয়া হয়, তবে জরুরি পরিষেবা চালু থাকে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে সরকার টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করে, যা অর্থনীতিবিদদের মতে জিডিপির প্রায় ০.৩% হ্রাসের কারণ হতে পারে। (সূত্র: CPD ও অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

দিনমজুর নিম্নবিত্তের ওপর নির্মম চাপ

ঈদের ছুটির প্রভাব সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি—দিনমজুর, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ে। তারা প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যখন একটানা ছুটি চলে, তখন তাদের আয়ের উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জরিপ অনুযায়ী, ঈদ উপলক্ষে ৭০% দিনমজুরকে ঋণ করতে হয় পরিবারকে খাবার খাওয়াতে। (সূত্র: বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক, ২০২৩)

ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা ব্যাংকিং বিপর্যয়

এই ছুটির ফলে:

  • ব্যাংক বন্ধ: ঋণ নিষ্পত্তি, LC ক্লিয়ারেন্স, টাকা উত্তোলন, ATM রিফিল প্রক্রিয়া পর্যন্ত স্থবির হয়ে পড়ে।
  • আমদানিরপ্তানি বিলম্বিত: চট্টগ্রাম ও বেনাপোল বন্দরে পণ্যের কন্টেইনার জমে যায়। এতে করে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (সূত্র: বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)
  • শেয়ার বাজার: ১০ দিনের ছুটিতে শেয়ারবাজার কার্যত স্থবির, বিনিয়োগকারীদের হাতে নগদ অর্থ আটকে যায়।

জরুরি সেবা: ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত জনগণ

ঈদের ছুটিতে সরকারি হাসপাতালগুলো ‘অপারেশন ছাড়া কোনো পরিষেবা’ দেয় না বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। আদালত বন্ধ থাকায় জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ছুটি শেষে ছাড়া হয়, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। জরুরি প্রয়োজনে প্রশাসনিক সাড়া না পাওয়া নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ভেঙে দেয়।

রাষ্ট্র কি শিশুর মতো বিশ্রাম চায়?

রাষ্ট্র কোনো শিশুর মতো নয় যে তাকে ছুটি দিয়ে বিশ্রাম দিতে হবে। বরং রাষ্ট্র একটি চিরসচল মেশিন—যে মেশিন থেমে গেলে নাগরিকদের জীবনও থেমে যায়। যেমন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছিলেন, “The state is not a mechanical entity; it is a regulatory framework of life.” রাষ্ট্রের প্রতিটি মিনিট জনগণের কল্যাণে উৎসর্গিত হওয়া উচিত।

রাষ্ট্রীয় দর্শন দায়িত্বচ্যুতি

রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মনে থাকা উচিত, রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে একটি নৈতিক দায়িত্ব জড়িত। হান্না আরেন্ট যেমন বলেছিলেন: “The banality of irresponsibility is more dangerous than evil itself.” ছুটির নামে রাষ্ট্র তার কর্তব্যচ্যুতি ও দায়িত্বহীনতাকে বৈধতা দিচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য মারাত্মক।

ধর্মীয় বৈষম্য বৈষম্যমূলক নীতির সম্ভাবনা

যদি ঈদ উপলক্ষে ১০ দিনের ছুটি হয়, তাহলে দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা—এই ধর্মীয় উৎসবগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় এটি সংবিধানের ২৮(১) ধারা লঙ্ঘন করে, যেখানে বলা হয়েছে—“রাষ্ট্র কোনো ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির প্রতি বৈষম্য করবে না।” সংবিধানিক বৈষম্য রাষ্ট্রের সামাজিক শৃঙ্খলা ও সহনশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

প্রশাসনিক স্থবিরতা নাগরিকের আস্থাহীনতা

টানা ছুটির ফলে সাধারণ নাগরিক প্রতিদিনের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়:

  • দলিল নিবন্ধন ও ভূমি অফিসে ফাইল আটকে থাকে।
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে।
  • কোর্টের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিচার প্রার্থীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।

এভাবে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থা নষ্ট হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে।

করণীয়: নীতিগত ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ

সরকারের উচিত এ ধরনের ছুটির সংস্কৃতি পুনর্বিবেচনা করা। ছুটি হোক উৎসবের অভিব্যক্তি, কিন্তু তা যেন কখনো রাষ্ট্রের অচলাবস্থার প্রতীক না হয়। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে ‘রোটেশন সিস্টেমে’ দায়িত্ব পালনকারী কর্মী রাখা যেতে পারে। জরুরি সেবার মতো প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ভিন্ন নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।

উল্লেখযোগ্যভাবে, জাপানে ‘Golden Week’-এর সময় সরকার একটি “কেনাকাটার গাইড” ও জরুরি সেবা রুটিন প্রকাশ করে। আমরাও চাইলে বাংলাদেশে এর অনুকরণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ছুটির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি।

ছুটির নামে পলায়ন নয়, রাষ্ট্রচিন্তার জাগরণ হোক মূলমন্ত্র

রাষ্ট্র শুধুমাত্র উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করতে পারে না। তাকে প্রতিনিয়ত জনগণের সেবা দিতে হয়। টানা ছুটি প্রশাসনিক অক্ষমতা, দায়িত্বচ্যুতি ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি। ঈদের আনন্দ হোক উদযাপনের উপলক্ষ, কিন্তু রাষ্ট্র যেন তার চিরসচলতা, দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে।

এভাবে ঈদের আনন্দ যেন রাষ্ট্রের স্থবিরতার বিনিময়ে অর্জিত না হয়—এই হোক চেতনার প্রেরণা।

 

তথ্যসূত্র:

  1. CPD Annual Economic Review, 2024
  2. Hannah Arendt, The Human Condition, 1958
  3. Michel Foucault, Society Must Be Defended, 1975
  4. BRAC Humanitarian Research, 2023
  5. Constitution of Bangladesh, Article 28
  6. Business Standard Bangladesh, Eid Supply Chain Analysis, 2023

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share