সময়: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

১৮৬ দেশের মাঝে একমাত্র গায়ানা—সম্পূর্ণ খাদ্য স্বনির্ভর রাষ্ট্র— প্রকাশ্যে এল এক চাঞ্চল্যকর গবেষণা

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৭:৫৯:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫
  • / ১২৮ Time View

guyana

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

guyana

✍️ অনুবাদ ও সংকলন: বিলাল হোসেন

বিশ্ব যখন ক্রমাগত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে এবং আমদানিনির্ভরতায় আক্রান্ত, ঠিক তখনই এক ব্যতিক্রমী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য—১৮৬টি দেশের মধ্যে মাত্র একটি দেশ সম্পূর্ণভাবে নিজের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেই উৎপাদন করে। সেই দেশটি হলো দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট রাষ্ট্র গায়ানা

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল Nature Food-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গায়ানাই একমাত্র দেশ, যা ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য—এই সাতটি প্রধান খাদ্য উপাদানে নিজ দেশের জনগণের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।

কেন গায়ানা ব্যতিক্রম?

দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত গায়ানার পশ্চিমে ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণে ব্রাজিল, পূর্বে সুরিনাম এবং উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর। মাত্র ৮ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশের রয়েছে বিশাল উর্বর কৃষিজমি, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও অনুকূল জলবায়ু—যা কৃষি উৎপাদনের জন্য আদর্শ।

গবেষকরা বলছেন, গায়ানার কৃষিখাত মূলত দেশীয় চাহিদা পূরণে নিবেদিত, রপ্তানিমুখী নয়। এই অন্তর্মুখী কৌশলই গায়ানাকে খাদ্যে পূর্ণ স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে দিয়েছে।

গবেষণার অন্তরালে

জার্মানির গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে World

Wildlife Fund-এর “Livewell Diet” মডেল ব্যবহার করে প্রতিটি দেশের খাদ্য উৎপাদন এবং জনসংখ্যার পুষ্টিগত চাহিদা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় উঠে আসে, বিশ্বের প্রায় ৬৫% দেশ মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য অতিরিক্ত উৎপাদন করলেও স্বাস্থ্যকর উদ্ভিজ্জ খাদ্যে ঘাটতি রয়েছে। মাত্র ২৪% দেশ পর্যাপ্ত শাকসবজি উৎপাদনে সক্ষম, এবং এর চেয়েও কম দেশ যথেষ্ট উদ্ভিদভিত্তিক প্রোটিন বা শর্করা জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারে।

গায়ানার পরে চীন ও ভিয়েতনাম ছয়টি খাদ্য উপাদানে স্বনির্ভরতা অর্জন করলেও, পূর্ণ সাতটিতেই সক্ষম একমাত্র দেশ গায়ানা

বৈশ্বিক বৈষম্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল

বেশ কিছু উন্নত দেশ খাদ্য উৎপাদনে কিছু নির্দিষ্ট খাতে শক্তিশালী হলেও অধিকাংশ দেশ খাদ্য আমদানির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। বিশেষ করে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, আরব উপসাগরীয় অঞ্চল ও নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর স্থানীয় উৎপাদন জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ।

গবেষণায় দেখা যায়, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, ম্যাকাও, কাতার ও ইয়েমেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে—এই দেশগুলো সাতটি খাদ্য বিভাগের প্রতিটিতেই আমদানির উপর নির্ভরশীল।

বিশেষজ্ঞ মত ভবিষ্যৎ ভাবনা

গবেষণার প্রধান লেখক ড. জোনাস স্টুল (গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন,

“স্বনির্ভরতা না থাকলেই যে কোনো দেশ পিছিয়ে, তা নয়। অনেক দেশের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা আছে। সেক্ষেত্রে পরিকল্পিত আমদানি নীতিও একটি কার্যকর সমাধান।”

তবে তিনি সতর্ক করে দেন, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা বিশ্বব্যাপী সংকটে ভয়াবহ খাদ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ—যেখানে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে বহু দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন,

“জাতীয় খাদ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এটা জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি নির্ভরতা কমানোর প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।”

গায়ানার পথ কি অনুসরণযোগ্য?

এই গবেষণা নতুন করে আলোচনায় এনেছে খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও টেকসই কৃষিনীতির প্রয়োজনীয়তা। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-সংঘাত ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার অস্থিরতার যুগে খাদ্যে স্বনির্ভরতা কেবল একটি নীতিগত পছন্দ নয়—এটি একটি কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়

যদিও প্রতিটি দেশের ভূপ্রকৃতি ও অর্থনৈতিক কাঠামো আলাদা, তবুও গায়ানার উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য দেশগুলো স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো, খাদ্য উৎসে বৈচিত্র্য আনা এবং টেকসই বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে।

গায়ানার অভূতপূর্ব স্বনির্ভরতা গোটা বিশ্বের জন্য এক অনুপ্রেরণা। প্রমাণ হয়ে গেল, জনসংখ্যা কিংবা আকার নয়—খাদ্য নিরাপত্তার আসল চাবিকাঠি হলো দূরদর্শী কৃষিনীতি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার যুগে খাদ্যে স্বনির্ভরতা হতে পারে জাতীয় স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

তথ্যসূত্র: BBC Science Focus, Nature Food Journal

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

১৮৬ দেশের মাঝে একমাত্র গায়ানা—সম্পূর্ণ খাদ্য স্বনির্ভর রাষ্ট্র— প্রকাশ্যে এল এক চাঞ্চল্যকর গবেষণা

Update Time : ০৭:৫৯:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

guyana

✍️ অনুবাদ ও সংকলন: বিলাল হোসেন

বিশ্ব যখন ক্রমাগত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে এবং আমদানিনির্ভরতায় আক্রান্ত, ঠিক তখনই এক ব্যতিক্রমী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য—১৮৬টি দেশের মধ্যে মাত্র একটি দেশ সম্পূর্ণভাবে নিজের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেই উৎপাদন করে। সেই দেশটি হলো দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট রাষ্ট্র গায়ানা

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল Nature Food-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গায়ানাই একমাত্র দেশ, যা ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য—এই সাতটি প্রধান খাদ্য উপাদানে নিজ দেশের জনগণের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।

কেন গায়ানা ব্যতিক্রম?

দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত গায়ানার পশ্চিমে ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণে ব্রাজিল, পূর্বে সুরিনাম এবং উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর। মাত্র ৮ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশের রয়েছে বিশাল উর্বর কৃষিজমি, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও অনুকূল জলবায়ু—যা কৃষি উৎপাদনের জন্য আদর্শ।

গবেষকরা বলছেন, গায়ানার কৃষিখাত মূলত দেশীয় চাহিদা পূরণে নিবেদিত, রপ্তানিমুখী নয়। এই অন্তর্মুখী কৌশলই গায়ানাকে খাদ্যে পূর্ণ স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে দিয়েছে।

গবেষণার অন্তরালে

জার্মানির গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে World

Wildlife Fund-এর “Livewell Diet” মডেল ব্যবহার করে প্রতিটি দেশের খাদ্য উৎপাদন এবং জনসংখ্যার পুষ্টিগত চাহিদা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় উঠে আসে, বিশ্বের প্রায় ৬৫% দেশ মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য অতিরিক্ত উৎপাদন করলেও স্বাস্থ্যকর উদ্ভিজ্জ খাদ্যে ঘাটতি রয়েছে। মাত্র ২৪% দেশ পর্যাপ্ত শাকসবজি উৎপাদনে সক্ষম, এবং এর চেয়েও কম দেশ যথেষ্ট উদ্ভিদভিত্তিক প্রোটিন বা শর্করা জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারে।

গায়ানার পরে চীন ও ভিয়েতনাম ছয়টি খাদ্য উপাদানে স্বনির্ভরতা অর্জন করলেও, পূর্ণ সাতটিতেই সক্ষম একমাত্র দেশ গায়ানা

বৈশ্বিক বৈষম্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল

বেশ কিছু উন্নত দেশ খাদ্য উৎপাদনে কিছু নির্দিষ্ট খাতে শক্তিশালী হলেও অধিকাংশ দেশ খাদ্য আমদানির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। বিশেষ করে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, আরব উপসাগরীয় অঞ্চল ও নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর স্থানীয় উৎপাদন জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ।

গবেষণায় দেখা যায়, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, ম্যাকাও, কাতার ও ইয়েমেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে—এই দেশগুলো সাতটি খাদ্য বিভাগের প্রতিটিতেই আমদানির উপর নির্ভরশীল।

বিশেষজ্ঞ মত ভবিষ্যৎ ভাবনা

গবেষণার প্রধান লেখক ড. জোনাস স্টুল (গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন,

“স্বনির্ভরতা না থাকলেই যে কোনো দেশ পিছিয়ে, তা নয়। অনেক দেশের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা আছে। সেক্ষেত্রে পরিকল্পিত আমদানি নীতিও একটি কার্যকর সমাধান।”

তবে তিনি সতর্ক করে দেন, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা বিশ্বব্যাপী সংকটে ভয়াবহ খাদ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ—যেখানে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে বহু দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন,

“জাতীয় খাদ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এটা জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি নির্ভরতা কমানোর প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।”

গায়ানার পথ কি অনুসরণযোগ্য?

এই গবেষণা নতুন করে আলোচনায় এনেছে খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও টেকসই কৃষিনীতির প্রয়োজনীয়তা। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-সংঘাত ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার অস্থিরতার যুগে খাদ্যে স্বনির্ভরতা কেবল একটি নীতিগত পছন্দ নয়—এটি একটি কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়

যদিও প্রতিটি দেশের ভূপ্রকৃতি ও অর্থনৈতিক কাঠামো আলাদা, তবুও গায়ানার উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য দেশগুলো স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো, খাদ্য উৎসে বৈচিত্র্য আনা এবং টেকসই বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে।

গায়ানার অভূতপূর্ব স্বনির্ভরতা গোটা বিশ্বের জন্য এক অনুপ্রেরণা। প্রমাণ হয়ে গেল, জনসংখ্যা কিংবা আকার নয়—খাদ্য নিরাপত্তার আসল চাবিকাঠি হলো দূরদর্শী কৃষিনীতি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার যুগে খাদ্যে স্বনির্ভরতা হতে পারে জাতীয় স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

তথ্যসূত্র: BBC Science Focus, Nature Food Journal

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share