সাণ্ডা: মরুভূমির সরীসৃপ ও লোকজ চিকিৎসার বিতর্কিত উপাদান

- Update Time : ১০:২২:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
- / ১৩৬ Time View

সাণ্ডা একটি মধ্যাকৃতির সরীসৃপ প্রাণী, যেটি সাধারণত শুষ্ক, উষর ও মরুভূমি এলাকায় বাস করে। এটি দেখতে অনেকটা গিরগিটির মতো হলেও শরীর মোটা, শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে ধীরগতির। সাণ্ডার শরীরে ছোট ছোট আঁশ থাকে এবং এর লেজটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ, যা এটি আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। এই প্রাণীটি পরিবেশের সাথে চমৎকারভাবে অভিযোজিত এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে একে “গোসাপ” বা “মেটে টিকটিকি” নামেও ডাকা হয়।
সাণ্ডার বাসস্থান ও আচরণ
সাণ্ডা সাধারণত শুষ্ক পাথুরে এলাকা, বালুকাময় মরুভূমি ও তৃণভূমিতে বাস করে। এরা মাটির গর্তে বাস করে এবং দিনের বেলায় রোদ পোহায়। এরা একাকী জীবনযাপন করে এবং নিজের এলাকা প্রতিরক্ষার জন্য লেজ ব্যবহার করে। অনেক সময় শত্রুর কাছ থেকে আত্মরক্ষায় লেজ দিয়ে আঘাত করে।
খাদ্যাভ্যাস
সাণ্ডা মূলত তৃণভোজী হলেও কিছু প্রজাতি কীট-পতঙ্গও খেয়ে থাকে। ঘাস, গুল্ম ও পাতাই এদের প্রধান খাবার। তবে কিছু এলাকায় এদের মাংসাহারী বলেও ধরা হয়। এদের খাদ্যাভ্যাস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।
লোকজ চিকিৎসা ও সাণ্ডার তথাকথিত ঔষধি ব্যবহার
দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই সাণ্ডার তেল ও মাংসকে লোকজ চিকিৎসায় একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে, পুরুষত্বহীনতা (ইরেকটাইল ডিসফাংশন), যৌন দুর্বলতা, বাতব্যথা, পেশির ব্যথা ও নানা ধরনের ব্যথানাশক হিসেবে সাণ্ডার তেল ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
সাণ্ডার তেল: কীভাবে তৈরি হয়?
সাণ্ডার তেল তৈরি করার জন্য এই প্রাণীটিকে শিকার করে, তারপর তার চর্বি বা দেহগলিত অংশ থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। কিছু তথাকথিত কবিরাজ বা হাকিম এই তেলকে ‘প্রাকৃতিক ভায়াগ্রা’ বলেও প্রচার করে থাকেন। এটি সাধারণত সান্দা তেল নামে বাজারে বিক্রি হয়, যা যৌন উত্তেজক তেল হিসেবে বাজারজাত করা হয়।
❖ প্রচলিত ব্যবহারসমূহ:
- যৌন দুর্বলতা বা পুরুষত্বহীনতায় মালিশ হিসেবে
- বাতব্যথা বা পেশির ব্যথায় বাহ্যিক ব্যবহারে
- কিছু হাকিম এটি মুখে সেবনের জন্যও ব্যবহার করেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও সতর্কতা
সাণ্ডার তেল ও মাংসের যেসব ঔষধি গুণের দাবি করা হয়, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণ মেলেনি যে সাণ্ডার তেল যৌন স্বাস্থ্য বা ব্যথানাশে কার্যকর। বরং এসব দাবিকে অনেক সময় ছলচাতুরি ও ঠকবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে:
- ডা. ফারহানা রহমান, প্রাণিবিজ্ঞানী, বলেন: “সাণ্ডার তেল সম্পূর্ণ একটি লোকজ ধারণা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো স্থান নেই। বরং এটি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি ভয়ানক দৃষ্টান্ত।”
- WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের প্রাণীর নিষ্ঠুর শিকার এবং অনিরীক্ষিত ঔষধি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কতা জারি করেছে।
পরিবেশগত হুমকি ও সংরক্ষণের প্রয়োজন
অতিরিক্ত শিকার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সাণ্ডা ধরার ফলে এই প্রজাতিটি আজ অনেক অঞ্চলে বিলুপ্তির মুখে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক জায়গায় সাণ্ডা এখন সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত, এবং এদের শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাণ্ডার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এরা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাটির নিচে গর্ত খনন করে অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
সাণ্ডা একটি নিরীহ এবং পরিবেশবান্ধব প্রাণী। লোকজ বিশ্বাসে এর তেল ও মাংস নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এই ভুল ধারণার কারণে প্রাণীটি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
আজ প্রয়োজন সচেতনতা, গবেষণামূলক শিক্ষা এবং আইনি প্রয়োগ। লোকজ চিকিৎসার নামে প্রাণী হত্যার পথ থেকে আমাদের ফিরতে হবে। প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণই পারে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।
Please Share This Post in Your Social Media

সাণ্ডা: মরুভূমির সরীসৃপ ও লোকজ চিকিৎসার বিতর্কিত উপাদান


সাণ্ডা একটি মধ্যাকৃতির সরীসৃপ প্রাণী, যেটি সাধারণত শুষ্ক, উষর ও মরুভূমি এলাকায় বাস করে। এটি দেখতে অনেকটা গিরগিটির মতো হলেও শরীর মোটা, শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে ধীরগতির। সাণ্ডার শরীরে ছোট ছোট আঁশ থাকে এবং এর লেজটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ, যা এটি আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। এই প্রাণীটি পরিবেশের সাথে চমৎকারভাবে অভিযোজিত এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে একে “গোসাপ” বা “মেটে টিকটিকি” নামেও ডাকা হয়।
সাণ্ডার বাসস্থান ও আচরণ
সাণ্ডা সাধারণত শুষ্ক পাথুরে এলাকা, বালুকাময় মরুভূমি ও তৃণভূমিতে বাস করে। এরা মাটির গর্তে বাস করে এবং দিনের বেলায় রোদ পোহায়। এরা একাকী জীবনযাপন করে এবং নিজের এলাকা প্রতিরক্ষার জন্য লেজ ব্যবহার করে। অনেক সময় শত্রুর কাছ থেকে আত্মরক্ষায় লেজ দিয়ে আঘাত করে।
খাদ্যাভ্যাস
সাণ্ডা মূলত তৃণভোজী হলেও কিছু প্রজাতি কীট-পতঙ্গও খেয়ে থাকে। ঘাস, গুল্ম ও পাতাই এদের প্রধান খাবার। তবে কিছু এলাকায় এদের মাংসাহারী বলেও ধরা হয়। এদের খাদ্যাভ্যাস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।
লোকজ চিকিৎসা ও সাণ্ডার তথাকথিত ঔষধি ব্যবহার
দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই সাণ্ডার তেল ও মাংসকে লোকজ চিকিৎসায় একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে, পুরুষত্বহীনতা (ইরেকটাইল ডিসফাংশন), যৌন দুর্বলতা, বাতব্যথা, পেশির ব্যথা ও নানা ধরনের ব্যথানাশক হিসেবে সাণ্ডার তেল ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
সাণ্ডার তেল: কীভাবে তৈরি হয়?
সাণ্ডার তেল তৈরি করার জন্য এই প্রাণীটিকে শিকার করে, তারপর তার চর্বি বা দেহগলিত অংশ থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। কিছু তথাকথিত কবিরাজ বা হাকিম এই তেলকে ‘প্রাকৃতিক ভায়াগ্রা’ বলেও প্রচার করে থাকেন। এটি সাধারণত সান্দা তেল নামে বাজারে বিক্রি হয়, যা যৌন উত্তেজক তেল হিসেবে বাজারজাত করা হয়।
❖ প্রচলিত ব্যবহারসমূহ:
- যৌন দুর্বলতা বা পুরুষত্বহীনতায় মালিশ হিসেবে
- বাতব্যথা বা পেশির ব্যথায় বাহ্যিক ব্যবহারে
- কিছু হাকিম এটি মুখে সেবনের জন্যও ব্যবহার করেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও সতর্কতা
সাণ্ডার তেল ও মাংসের যেসব ঔষধি গুণের দাবি করা হয়, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণ মেলেনি যে সাণ্ডার তেল যৌন স্বাস্থ্য বা ব্যথানাশে কার্যকর। বরং এসব দাবিকে অনেক সময় ছলচাতুরি ও ঠকবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে:
- ডা. ফারহানা রহমান, প্রাণিবিজ্ঞানী, বলেন: “সাণ্ডার তেল সম্পূর্ণ একটি লোকজ ধারণা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো স্থান নেই। বরং এটি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি ভয়ানক দৃষ্টান্ত।”
- WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের প্রাণীর নিষ্ঠুর শিকার এবং অনিরীক্ষিত ঔষধি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কতা জারি করেছে।
পরিবেশগত হুমকি ও সংরক্ষণের প্রয়োজন
অতিরিক্ত শিকার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সাণ্ডা ধরার ফলে এই প্রজাতিটি আজ অনেক অঞ্চলে বিলুপ্তির মুখে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক জায়গায় সাণ্ডা এখন সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত, এবং এদের শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাণ্ডার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এরা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাটির নিচে গর্ত খনন করে অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
সাণ্ডা একটি নিরীহ এবং পরিবেশবান্ধব প্রাণী। লোকজ বিশ্বাসে এর তেল ও মাংস নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এই ভুল ধারণার কারণে প্রাণীটি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
আজ প্রয়োজন সচেতনতা, গবেষণামূলক শিক্ষা এবং আইনি প্রয়োগ। লোকজ চিকিৎসার নামে প্রাণী হত্যার পথ থেকে আমাদের ফিরতে হবে। প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণই পারে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।