সময়: বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

সাণ্ডা: মরুভূমির সরীসৃপ ও লোকজ চিকিৎসার বিতর্কিত উপাদান

বিল্লাল হোসেন
  • Update Time : ১০:২২:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
  • / ১৩৬ Time View

sanda(1)

শেয়ার করুনঃ
Pin Share
sanda(1)
 

সাণ্ডা একটি মধ্যাকৃতির সরীসৃপ প্রাণী, যেটি সাধারণত শুষ্ক, উষর ও মরুভূমি এলাকায় বাস করে। এটি দেখতে অনেকটা গিরগিটির মতো হলেও শরীর মোটা, শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে ধীরগতির। সাণ্ডার শরীরে ছোট ছোট আঁশ থাকে এবং এর লেজটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ, যা এটি আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। এই প্রাণীটি পরিবেশের সাথে চমৎকারভাবে অভিযোজিত এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে একে “গোসাপ” বা “মেটে টিকটিকি” নামেও ডাকা হয়।

সাণ্ডার বাসস্থান আচরণ

সাণ্ডা সাধারণত শুষ্ক পাথুরে এলাকা, বালুকাময় মরুভূমি ও তৃণভূমিতে বাস করে। এরা মাটির গর্তে বাস করে এবং দিনের বেলায় রোদ পোহায়। এরা একাকী জীবনযাপন করে এবং নিজের এলাকা প্রতিরক্ষার জন্য লেজ ব্যবহার করে। অনেক সময় শত্রুর কাছ থেকে আত্মরক্ষায় লেজ দিয়ে আঘাত করে।

খাদ্যাভ্যাস

সাণ্ডা মূলত তৃণভোজী হলেও কিছু প্রজাতি কীট-পতঙ্গও খেয়ে থাকে। ঘাস, গুল্ম ও পাতাই এদের প্রধান খাবার। তবে কিছু এলাকায় এদের মাংসাহারী বলেও ধরা হয়। এদের খাদ্যাভ্যাস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।

 

লোকজ চিকিৎসা সাণ্ডার তথাকথিত ঔষধি ব্যবহার

দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই সাণ্ডার তেল ও মাংসকে লোকজ চিকিৎসায় একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে, পুরুষত্বহীনতা (ইরেকটাইল ডিসফাংশন), যৌন দুর্বলতা, বাতব্যথা, পেশির ব্যথা ও নানা ধরনের ব্যথানাশক হিসেবে সাণ্ডার তেল ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

সাণ্ডার তেল: কীভাবে তৈরি হয়?

সাণ্ডার তেল তৈরি করার জন্য এই প্রাণীটিকে শিকার করে, তারপর তার চর্বি বা দেহগলিত অংশ থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। কিছু তথাকথিত কবিরাজ বা হাকিম এই তেলকে ‘প্রাকৃতিক ভায়াগ্রা’ বলেও প্রচার করে থাকেন। এটি সাধারণত সান্দা তেল নামে বাজারে বিক্রি হয়, যা যৌন উত্তেজক তেল হিসেবে বাজারজাত করা হয়।

প্রচলিত ব্যবহারসমূহ:

  • যৌন দুর্বলতা বা পুরুষত্বহীনতায় মালিশ হিসেবে
  • বাতব্যথা বা পেশির ব্যথায় বাহ্যিক ব্যবহারে
  • কিছু হাকিম এটি মুখে সেবনের জন্যও ব্যবহার করেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ

 

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সতর্কতা

সাণ্ডার তেল ও মাংসের যেসব ঔষধি গুণের দাবি করা হয়, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণ মেলেনি যে সাণ্ডার তেল যৌন স্বাস্থ্য বা ব্যথানাশে কার্যকর। বরং এসব দাবিকে অনেক সময় ছলচাতুরি ঠকবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে:

  • ডা. ফারহানা রহমান, প্রাণিবিজ্ঞানী, বলেন: “সাণ্ডার তেল সম্পূর্ণ একটি লোকজ ধারণা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো স্থান নেই। বরং এটি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি ভয়ানক দৃষ্টান্ত।”
  • WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের প্রাণীর নিষ্ঠুর শিকার এবং অনিরীক্ষিত ঔষধি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কতা জারি করেছে।

 

পরিবেশগত হুমকি সংরক্ষণের প্রয়োজন

অতিরিক্ত শিকার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সাণ্ডা ধরার ফলে এই প্রজাতিটি আজ অনেক অঞ্চলে বিলুপ্তির মুখে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক জায়গায় সাণ্ডা এখন সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত, এবং এদের শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাণ্ডার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এরা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাটির নিচে গর্ত খনন করে অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

সাণ্ডা একটি নিরীহ এবং পরিবেশবান্ধব প্রাণী। লোকজ বিশ্বাসে এর তেল ও মাংস নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এই ভুল ধারণার কারণে প্রাণীটি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

আজ প্রয়োজন সচেতনতা, গবেষণামূলক শিক্ষা এবং আইনি প্রয়োগ। লোকজ চিকিৎসার নামে প্রাণী হত্যার পথ থেকে আমাদের ফিরতে হবে। প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণই পারে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
About Author Information

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন, একজন প্রজ্ঞাবান পেশাজীবী, যিনি গণিতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। তার আর্থিক খাতে যাত্রা তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকিং Inc. এবং ব্যাংক-আল-বিলাদে বিদেশী সম্পর্ক ও করেসপন্ডেন্ট মেইন্টেনেন্স অফিসার হিসেবে। প্রথাগত অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে, বিল্লাল একজন প্রখ্যাত লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে মননশীল কলাম ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। তার দক্ষতা বিস্তৃত বিষয় জুড়ে রয়েছে, যেমন অর্থনীতির জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, রেমিটেন্স, রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত দিক। বিল্লাল তার লেখায় একটি অনন্য বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে একত্রিত করে একাডেমিক কঠোরতার সাথে। তার প্রবন্ধগুলো শুধুমাত্র জটিল বিষয়গুলির উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন নয়, বরং পাঠকদের জন্য জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। বিল্লাল হোসেনের অবদান তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে, তিনি আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জটিলতাগুলি উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিস্তৃত এবং আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার দিকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

সাণ্ডা: মরুভূমির সরীসৃপ ও লোকজ চিকিৎসার বিতর্কিত উপাদান

Update Time : ১০:২২:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share
sanda(1)
 

সাণ্ডা একটি মধ্যাকৃতির সরীসৃপ প্রাণী, যেটি সাধারণত শুষ্ক, উষর ও মরুভূমি এলাকায় বাস করে। এটি দেখতে অনেকটা গিরগিটির মতো হলেও শরীর মোটা, শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে ধীরগতির। সাণ্ডার শরীরে ছোট ছোট আঁশ থাকে এবং এর লেজটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ, যা এটি আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। এই প্রাণীটি পরিবেশের সাথে চমৎকারভাবে অভিযোজিত এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে একে “গোসাপ” বা “মেটে টিকটিকি” নামেও ডাকা হয়।

সাণ্ডার বাসস্থান আচরণ

সাণ্ডা সাধারণত শুষ্ক পাথুরে এলাকা, বালুকাময় মরুভূমি ও তৃণভূমিতে বাস করে। এরা মাটির গর্তে বাস করে এবং দিনের বেলায় রোদ পোহায়। এরা একাকী জীবনযাপন করে এবং নিজের এলাকা প্রতিরক্ষার জন্য লেজ ব্যবহার করে। অনেক সময় শত্রুর কাছ থেকে আত্মরক্ষায় লেজ দিয়ে আঘাত করে।

খাদ্যাভ্যাস

সাণ্ডা মূলত তৃণভোজী হলেও কিছু প্রজাতি কীট-পতঙ্গও খেয়ে থাকে। ঘাস, গুল্ম ও পাতাই এদের প্রধান খাবার। তবে কিছু এলাকায় এদের মাংসাহারী বলেও ধরা হয়। এদের খাদ্যাভ্যাস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।

 

লোকজ চিকিৎসা সাণ্ডার তথাকথিত ঔষধি ব্যবহার

দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই সাণ্ডার তেল ও মাংসকে লোকজ চিকিৎসায় একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে, পুরুষত্বহীনতা (ইরেকটাইল ডিসফাংশন), যৌন দুর্বলতা, বাতব্যথা, পেশির ব্যথা ও নানা ধরনের ব্যথানাশক হিসেবে সাণ্ডার তেল ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

সাণ্ডার তেল: কীভাবে তৈরি হয়?

সাণ্ডার তেল তৈরি করার জন্য এই প্রাণীটিকে শিকার করে, তারপর তার চর্বি বা দেহগলিত অংশ থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। কিছু তথাকথিত কবিরাজ বা হাকিম এই তেলকে ‘প্রাকৃতিক ভায়াগ্রা’ বলেও প্রচার করে থাকেন। এটি সাধারণত সান্দা তেল নামে বাজারে বিক্রি হয়, যা যৌন উত্তেজক তেল হিসেবে বাজারজাত করা হয়।

প্রচলিত ব্যবহারসমূহ:

  • যৌন দুর্বলতা বা পুরুষত্বহীনতায় মালিশ হিসেবে
  • বাতব্যথা বা পেশির ব্যথায় বাহ্যিক ব্যবহারে
  • কিছু হাকিম এটি মুখে সেবনের জন্যও ব্যবহার করেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ

 

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সতর্কতা

সাণ্ডার তেল ও মাংসের যেসব ঔষধি গুণের দাবি করা হয়, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণ মেলেনি যে সাণ্ডার তেল যৌন স্বাস্থ্য বা ব্যথানাশে কার্যকর। বরং এসব দাবিকে অনেক সময় ছলচাতুরি ঠকবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে:

  • ডা. ফারহানা রহমান, প্রাণিবিজ্ঞানী, বলেন: “সাণ্ডার তেল সম্পূর্ণ একটি লোকজ ধারণা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো স্থান নেই। বরং এটি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি ভয়ানক দৃষ্টান্ত।”
  • WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের প্রাণীর নিষ্ঠুর শিকার এবং অনিরীক্ষিত ঔষধি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কতা জারি করেছে।

 

পরিবেশগত হুমকি সংরক্ষণের প্রয়োজন

অতিরিক্ত শিকার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সাণ্ডা ধরার ফলে এই প্রজাতিটি আজ অনেক অঞ্চলে বিলুপ্তির মুখে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক জায়গায় সাণ্ডা এখন সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত, এবং এদের শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাণ্ডার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এরা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে এবং মাটির নিচে গর্ত খনন করে অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

সাণ্ডা একটি নিরীহ এবং পরিবেশবান্ধব প্রাণী। লোকজ বিশ্বাসে এর তেল ও মাংস নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এই ভুল ধারণার কারণে প্রাণীটি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

আজ প্রয়োজন সচেতনতা, গবেষণামূলক শিক্ষা এবং আইনি প্রয়োগ। লোকজ চিকিৎসার নামে প্রাণী হত্যার পথ থেকে আমাদের ফিরতে হবে। প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণই পারে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share