সময়: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

শনিবারে ছুটি নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা উচিত — উন্নত বিশ্বের আদর্শ অনুসরণে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি

বিল্লাল হোসেন
  • Update Time : ০৭:৩৯:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • / ২০৩ Time View

EDUCATTION SATURDAY

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

EDUCATTION SATURDAY

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এক গভীর সংকটে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা দলীয়করণ, প্রশাসনিক দুর্বলতা, শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব এবং পাঠ্যবইয়ের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি শিক্ষার সময়সংকোচন— এসব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা কাঠামো কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো— বর্তমানে বাংলাদেশে শুক্রবার ও শনিবার, সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকায় শিক্ষার্থীদের কার্যকর শ্রেণিকক্ষ উপস্থিতি ২০০ দিনের নিচে নেমে এসেছে, যা UNESCO-এর ন্যূনতম সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য অপর্যাপ্ত (সূত্র: UNESCO Education for All Report, 2021)।

বাংলাদেশে শনিবারের ছুটি: রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, শিক্ষার জন্য আত্মঘাতী

শনিবারের ছুটি প্রথা চালু হয় মূলত বিদ্যুৎ জ্বালানি সাশ্রয়ের অজুহাতে সরকারি দপ্তরের কর্মঘণ্টা কমানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা খাতে কেন এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ফেলা হলো? শিক্ষা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সময়ই সবচেয়ে বড় সম্পদ।তাতে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার ধারাবাহিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি ছুটির সাথে মিলিয়ে পরিবারে একধরনের অবকাশকালীন সংস্কৃতি তৈরি হলেও, শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘লস্ট লার্নিং টাইম’।

বাংলাদেশে সরকারি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে গড়ে বছরে ১২০–১৩০ দিন ক্লাস হয়, যা বিশ্বমানদণ্ডে অপ্রতুল। UNESCO সুপারিশ করে প্রতি বছর অন্তত ২০০

কার্যকর শ্রেণিকক্ষ দিন রাখার জন্য (UNESCO Global Education Monitoring Report, 2023)।

উন্নত বিশ্বের উদাহরণ: শনিবার ছুটি নেই, বরং সক্রিয় শিক্ষা কার্যক্রম

. জাপান

জাপান দীর্ঘদিন ধরে একটি কঠোর ও সুশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রেখেছে। ২০০২ সাল পর্যন্ত জাপানের স্কুলগুলোতে সপ্তাহে ছয়দিন, অর্থাৎ শনিবারসহ পূর্ণ ক্লাস পরিচালিত হতো। যদিও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ২০০২ সালের পর ঐচ্ছিক ছুটির ব্যবস্থা চালু করা হয়, তথাপিও অধিকাংশ প্রাইভেট স্কুল এবং উন্নতমানের পাবলিক স্কুলগুলো এখনো শনিবারে পূর্ণদিবস ক্লাস পরিচালনা করে থাকে। তাদের বিশ্বাস, শেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সপ্তাহে ছয়দিনের শিক্ষাক্রম অপরিহার্য।
সূত্র: Ministry of Education, Culture, Sports, Science and Technology (MEXT), Japan, 2023.

. দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস করলেও বাস্তবে তারা সপ্তাহের ছয়দিন পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকে। শনিবারে তারা “হাকওন” নামক প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে গিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস, রিভিশন, এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পাঠে অংশ নেয়। এই ব্যাপক পরিশ্রম এবং সময়নিষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থার ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার্থীরা OECD পরিচালিত PISA (Programme for International Student Assessment) পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে শীর্ষস্থান অর্জন করছে। এটি প্রমাণ করে, শনিবার শিক্ষামূলক কার্যক্রমে যুক্ত থাকা তাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ।
সূত্র: OECD Education Report on South Korea, 2022.

. চীন

চীনের স্কুলগুলোতে সপ্তাহে ছয়দিন পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিশেষ করে শনিবারে পুনরাবৃত্তিমূলক পাঠদান, পরীক্ষার প্রস্তুতি, এবং সহপাঠ কার্যক্রম যেমন সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির ক্লাস আয়োজন করা হয়। এই ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিকভাবে নয়, মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। চীন বিশ্বাস করে, প্রতিটি দিন শিক্ষার্থীর উন্নয়নের সুযোগ, এবং শনিবার সেই সুযোগের একটি অতিরিক্ত দিন হিসেবে কাজ করে।
সূত্র: China Education Center, 2023.

. ভারত

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শনিবারে স্কুল খোলা রাখার রীতিতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও একটি সাধারণ ধারা হলো—সরকারি স্কুলগুলোতে শনিবার অর্ধদিবস এবং প্রাইভেট স্কুলগুলোতে পূর্ণদিবস ক্লাস চালু রয়েছে। বিশেষ করে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই অতিরিক্ত দিনটিকে শিক্ষার্থীদের জন্য পুনরাবৃত্তি ও অগ্রগামী পাঠদানের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। এতে ছাত্রছাত্রীদের শেখার মানসিকতা, ধারাবাহিকতা, এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি আরও মজবুত হয়।
 সূত্র: NCERT Annual Report, India, 2023.

. ফিনল্যান্ড সিঙ্গাপুর

ফিনল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও উভয় দেশে ছুটির দিন সংখ্যা সীমিত, তথাপি শনিবার দিনটিকে তারা সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করে। এই দিনে অনেক স্কুলে প্রজেক্ট ভিত্তিক ক্লাস, উপস্থাপনা, ও রিভিশন সেশন পরিচালনা করা হয়। সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা এবং শিক্ষকের মানোন্নয়ন তাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এবং শনিবারের এই কৌশলগত ব্যবহারে শিক্ষার গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি পায়।
সূত্র: World Bank Education Profile, 2022; PISA Country Comparison Data.

উপরোক্ত ব্যাখ্যা ও তথ্যসূত্রসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিশ্বের উন্নত ও শিক্ষাবান্ধব দেশগুলো শিক্ষার মানোন্নয়নে সপ্তাহে ছয়দিন শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকর ব্যবহার করে থাকে। শনিবারকে অতিরিক্ত ক্লাস, পুনরাবৃত্তি, এবং সৃজনশীল শিক্ষাকর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করায় শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ বাড়ে এবং সামগ্রিকভাবে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই ধারা বিবেচনায় এনে ছয়দিন ক্লাস চালুর মাধ্যমে শিক্ষা মান উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে ছয়দিন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে শিক্ষার মান ও সমতা নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ, সেখানে সপ্তাহে দুইদিন ছুটি রাখা দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে। ছয়দিন শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলে:

  • সিলেবাস শেষ করা সহজ হবে
  • সেশনজট হ্রাস পাবে
  • শ্রেণিকক্ষ উপস্থিতি বাড়বে
  • শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়বে
  • জাতীয় আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আসবে

শুধুমাত্র একদিন (শুক্রবার) ছুটি: সময়ের দাবি

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শুধুমাত্র একদিন ছুটি থাকে। যেমন:

  • জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত — ছয়দিন ক্লাস
  • যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র — পাঁচদিন ক্লাস, তবে কার্যকর ক্লাসঘণ্টা বেশি
  • সিঙ্গাপুর ফিনল্যান্ড — সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষ; ছুটির দিনেও কার্যক্রম চলে

অথচ বাংলাদেশে ছুটির পরপর দুইদিন একটানা বন্ধ থাকায় ক্লাসে মনোযোগ ফিরে পেতে শিক্ষার্থীদের সময় লাগে। এতে শেখার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। OECD-এর এক গবেষণায় বলা হয়, “Two consecutive non-academic days reduce learning retention significantly among low to mid-performing students.” (OECD Education Analysis, 2021)

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব: শিক্ষা সংস্কারে সময়োচিত পদক্ষেপ

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলমত নির্বিশেষে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনে মৌলিক সংস্কার আনবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত:

  1. শনিবার ছুটি বাতিল করে সপ্তাহে ছয়দিন শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করা
  2. একাডেমিক ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন করে সেশনজট নিরসন
  3. শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন
  4. শিক্ষায় দলীয়করণ দুর্নীতির অবসান

 “শুধু একদিন ছুটি, ছয়দিন শিক্ষা” — জাতি গঠনের মূলমন্ত্র

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, বৈষম্যপ্রবণ এবং দুর্বল অবকাঠামোর দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে সময়ের কার্যকর ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছানো জরুরি। শনিবার ছুটি তুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ছয়দিন চালু রাখার মধ্যে দিয়েই শুরু হতে পারে শিক্ষা বিপ্লব।

একদিন ছুটি (শুক্রবার) রেখে ছয়দিন পূর্ণদিবস ক্লাস বাধ্যতামূলক করা না হলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারব না। সময় এসেছে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার— “শুধু একদিন ছুটি, ছয়দিন শিক্ষা” এই শ্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে।

©billal Hossain

তথ্যসূত্র (References):

  1. UNESCO Education for All Global Monitoring Report, 2021
  2. OECD Education Outlook: South Korea, 2022
  3. MEXT Japan Official Education Policy, 2023
  4. China Education Center Reports, 2023
  5. NCERT Annual Education Report, India, 2023
  6. World Bank Education Overview: Singapore, Finland, 2022
  7. PISA 2022 Country Ranking Report
  8. OECD Learning Retention Analysis, 2021

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
About Author Information

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন, একজন প্রজ্ঞাবান পেশাজীবী, যিনি গণিতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। তার আর্থিক খাতে যাত্রা তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকিং Inc. এবং ব্যাংক-আল-বিলাদে বিদেশী সম্পর্ক ও করেসপন্ডেন্ট মেইন্টেনেন্স অফিসার হিসেবে। প্রথাগত অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে, বিল্লাল একজন প্রখ্যাত লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে মননশীল কলাম ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। তার দক্ষতা বিস্তৃত বিষয় জুড়ে রয়েছে, যেমন অর্থনীতির জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, রেমিটেন্স, রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত দিক। বিল্লাল তার লেখায় একটি অনন্য বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে একত্রিত করে একাডেমিক কঠোরতার সাথে। তার প্রবন্ধগুলো শুধুমাত্র জটিল বিষয়গুলির উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন নয়, বরং পাঠকদের জন্য জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। বিল্লাল হোসেনের অবদান তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে, তিনি আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জটিলতাগুলি উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিস্তৃত এবং আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার দিকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

শনিবারে ছুটি নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা উচিত — উন্নত বিশ্বের আদর্শ অনুসরণে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি

Update Time : ০৭:৩৯:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

EDUCATTION SATURDAY

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এক গভীর সংকটে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা দলীয়করণ, প্রশাসনিক দুর্বলতা, শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব এবং পাঠ্যবইয়ের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি শিক্ষার সময়সংকোচন— এসব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা কাঠামো কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো— বর্তমানে বাংলাদেশে শুক্রবার ও শনিবার, সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকায় শিক্ষার্থীদের কার্যকর শ্রেণিকক্ষ উপস্থিতি ২০০ দিনের নিচে নেমে এসেছে, যা UNESCO-এর ন্যূনতম সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য অপর্যাপ্ত (সূত্র: UNESCO Education for All Report, 2021)।

বাংলাদেশে শনিবারের ছুটি: রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, শিক্ষার জন্য আত্মঘাতী

শনিবারের ছুটি প্রথা চালু হয় মূলত বিদ্যুৎ জ্বালানি সাশ্রয়ের অজুহাতে সরকারি দপ্তরের কর্মঘণ্টা কমানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা খাতে কেন এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ফেলা হলো? শিক্ষা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সময়ই সবচেয়ে বড় সম্পদ।তাতে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার ধারাবাহিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি ছুটির সাথে মিলিয়ে পরিবারে একধরনের অবকাশকালীন সংস্কৃতি তৈরি হলেও, শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘লস্ট লার্নিং টাইম’।

বাংলাদেশে সরকারি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে গড়ে বছরে ১২০–১৩০ দিন ক্লাস হয়, যা বিশ্বমানদণ্ডে অপ্রতুল। UNESCO সুপারিশ করে প্রতি বছর অন্তত ২০০

কার্যকর শ্রেণিকক্ষ দিন রাখার জন্য (UNESCO Global Education Monitoring Report, 2023)।

উন্নত বিশ্বের উদাহরণ: শনিবার ছুটি নেই, বরং সক্রিয় শিক্ষা কার্যক্রম

. জাপান

জাপান দীর্ঘদিন ধরে একটি কঠোর ও সুশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রেখেছে। ২০০২ সাল পর্যন্ত জাপানের স্কুলগুলোতে সপ্তাহে ছয়দিন, অর্থাৎ শনিবারসহ পূর্ণ ক্লাস পরিচালিত হতো। যদিও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ২০০২ সালের পর ঐচ্ছিক ছুটির ব্যবস্থা চালু করা হয়, তথাপিও অধিকাংশ প্রাইভেট স্কুল এবং উন্নতমানের পাবলিক স্কুলগুলো এখনো শনিবারে পূর্ণদিবস ক্লাস পরিচালনা করে থাকে। তাদের বিশ্বাস, শেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সপ্তাহে ছয়দিনের শিক্ষাক্রম অপরিহার্য।
সূত্র: Ministry of Education, Culture, Sports, Science and Technology (MEXT), Japan, 2023.

. দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস করলেও বাস্তবে তারা সপ্তাহের ছয়দিন পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকে। শনিবারে তারা “হাকওন” নামক প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে গিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস, রিভিশন, এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পাঠে অংশ নেয়। এই ব্যাপক পরিশ্রম এবং সময়নিষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থার ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার্থীরা OECD পরিচালিত PISA (Programme for International Student Assessment) পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে শীর্ষস্থান অর্জন করছে। এটি প্রমাণ করে, শনিবার শিক্ষামূলক কার্যক্রমে যুক্ত থাকা তাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ।
সূত্র: OECD Education Report on South Korea, 2022.

. চীন

চীনের স্কুলগুলোতে সপ্তাহে ছয়দিন পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিশেষ করে শনিবারে পুনরাবৃত্তিমূলক পাঠদান, পরীক্ষার প্রস্তুতি, এবং সহপাঠ কার্যক্রম যেমন সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির ক্লাস আয়োজন করা হয়। এই ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিকভাবে নয়, মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। চীন বিশ্বাস করে, প্রতিটি দিন শিক্ষার্থীর উন্নয়নের সুযোগ, এবং শনিবার সেই সুযোগের একটি অতিরিক্ত দিন হিসেবে কাজ করে।
সূত্র: China Education Center, 2023.

. ভারত

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শনিবারে স্কুল খোলা রাখার রীতিতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও একটি সাধারণ ধারা হলো—সরকারি স্কুলগুলোতে শনিবার অর্ধদিবস এবং প্রাইভেট স্কুলগুলোতে পূর্ণদিবস ক্লাস চালু রয়েছে। বিশেষ করে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই অতিরিক্ত দিনটিকে শিক্ষার্থীদের জন্য পুনরাবৃত্তি ও অগ্রগামী পাঠদানের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। এতে ছাত্রছাত্রীদের শেখার মানসিকতা, ধারাবাহিকতা, এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি আরও মজবুত হয়।
 সূত্র: NCERT Annual Report, India, 2023.

. ফিনল্যান্ড সিঙ্গাপুর

ফিনল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও উভয় দেশে ছুটির দিন সংখ্যা সীমিত, তথাপি শনিবার দিনটিকে তারা সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করে। এই দিনে অনেক স্কুলে প্রজেক্ট ভিত্তিক ক্লাস, উপস্থাপনা, ও রিভিশন সেশন পরিচালনা করা হয়। সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা এবং শিক্ষকের মানোন্নয়ন তাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এবং শনিবারের এই কৌশলগত ব্যবহারে শিক্ষার গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি পায়।
সূত্র: World Bank Education Profile, 2022; PISA Country Comparison Data.

উপরোক্ত ব্যাখ্যা ও তথ্যসূত্রসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিশ্বের উন্নত ও শিক্ষাবান্ধব দেশগুলো শিক্ষার মানোন্নয়নে সপ্তাহে ছয়দিন শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকর ব্যবহার করে থাকে। শনিবারকে অতিরিক্ত ক্লাস, পুনরাবৃত্তি, এবং সৃজনশীল শিক্ষাকর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করায় শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ বাড়ে এবং সামগ্রিকভাবে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই ধারা বিবেচনায় এনে ছয়দিন ক্লাস চালুর মাধ্যমে শিক্ষা মান উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে ছয়দিন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে শিক্ষার মান ও সমতা নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ, সেখানে সপ্তাহে দুইদিন ছুটি রাখা দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে। ছয়দিন শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলে:

  • সিলেবাস শেষ করা সহজ হবে
  • সেশনজট হ্রাস পাবে
  • শ্রেণিকক্ষ উপস্থিতি বাড়বে
  • শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়বে
  • জাতীয় আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আসবে

শুধুমাত্র একদিন (শুক্রবার) ছুটি: সময়ের দাবি

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শুধুমাত্র একদিন ছুটি থাকে। যেমন:

  • জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত — ছয়দিন ক্লাস
  • যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র — পাঁচদিন ক্লাস, তবে কার্যকর ক্লাসঘণ্টা বেশি
  • সিঙ্গাপুর ফিনল্যান্ড — সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষ; ছুটির দিনেও কার্যক্রম চলে

অথচ বাংলাদেশে ছুটির পরপর দুইদিন একটানা বন্ধ থাকায় ক্লাসে মনোযোগ ফিরে পেতে শিক্ষার্থীদের সময় লাগে। এতে শেখার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। OECD-এর এক গবেষণায় বলা হয়, “Two consecutive non-academic days reduce learning retention significantly among low to mid-performing students.” (OECD Education Analysis, 2021)

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব: শিক্ষা সংস্কারে সময়োচিত পদক্ষেপ

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলমত নির্বিশেষে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনে মৌলিক সংস্কার আনবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত:

  1. শনিবার ছুটি বাতিল করে সপ্তাহে ছয়দিন শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করা
  2. একাডেমিক ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন করে সেশনজট নিরসন
  3. শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন
  4. শিক্ষায় দলীয়করণ দুর্নীতির অবসান

 “শুধু একদিন ছুটি, ছয়দিন শিক্ষা” — জাতি গঠনের মূলমন্ত্র

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, বৈষম্যপ্রবণ এবং দুর্বল অবকাঠামোর দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে সময়ের কার্যকর ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছানো জরুরি। শনিবার ছুটি তুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ছয়দিন চালু রাখার মধ্যে দিয়েই শুরু হতে পারে শিক্ষা বিপ্লব।

একদিন ছুটি (শুক্রবার) রেখে ছয়দিন পূর্ণদিবস ক্লাস বাধ্যতামূলক করা না হলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারব না। সময় এসেছে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার— “শুধু একদিন ছুটি, ছয়দিন শিক্ষা” এই শ্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে।

©billal Hossain

তথ্যসূত্র (References):

  1. UNESCO Education for All Global Monitoring Report, 2021
  2. OECD Education Outlook: South Korea, 2022
  3. MEXT Japan Official Education Policy, 2023
  4. China Education Center Reports, 2023
  5. NCERT Annual Education Report, India, 2023
  6. World Bank Education Overview: Singapore, Finland, 2022
  7. PISA 2022 Country Ranking Report
  8. OECD Learning Retention Analysis, 2021

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share