ভারত-পাকিস্তান: নতুন সংঘাতের পথে?

- Update Time : ০৬:০৪:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
- / ১২১ Time View
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী—ভারত ও পাকিস্তান—আবারো উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে। উপমহাদেশে বহু দশকের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক, যুদ্ধ, এবং সীমান্ত সংঘর্ষের ইতিহাসকে মাথায় রেখেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন: আবার কি নতুন কোনো বড় সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান?
উত্তেজনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালের বিভাজনের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত। ১৯৪৭–৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধসহ মোট চারটি যুদ্ধ হয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে। এর মূল কেন্দ্রে রয়েছে কাশ্মীর বিরোধ, যা উভয় দেশের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের বিষয়।
২০১৯ সালে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করে। তারা এই সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করে।
তথ্যসূত্র:
- গাঙ্গুলী, শিবাজি ও কপূর, সুমিত (২০১০)। India, Pakistan, and the Bomb. কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস
- ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (২০১৯)। “৩৭০ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত বিবৃতি”
নতুন উত্তেজনার কারণসমূহ
১. সীমান্ত সংঘর্ষ
২০২১ সালের যুদ্ধবিরতির চুক্তি সত্ত্বেও ২০২৪ সালের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর গোলাগুলি বেড়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী বলছে, ১০০-র বেশি সংঘর্ষ হয়েছে শুধুমাত্র প্রথম তিন মাসেই। পাকিস্তানও ভারতকে উস্কানির জন্য দায়ী করেছে।
তথ্যসূত্র:
- ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন (২০২৪)
- পাকিস্তান আইএসপিআর প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২. রাজনৈতিক বক্তব্য ও জাতীয়তাবাদ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান দেখা গেছে, যেখানে “পাক-অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধারের” মত বক্তব্য উঠে এসেছে। এর জবাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সতর্ক করে বলেছে যে, তারা “উপযুক্ত জবাব” দেবে।
তথ্যসূত্র:
- দ্য হিন্দু (মার্চ ২০২৫), “পিএম মোদি: পাক-অধিকৃত কাশ্মীর আমাদের”
- ডন (মার্চ ২০২৫), “পাক সেনাবাহিনী: ভারতের বক্তব্য উস্কানিমূলক”
৩. কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ
কাশ্মীরের পুনচ জেলায় মার্চ ২০২৫ সালে পাঁচজন ভারতীয় সেনা নিহত হয় এক জঙ্গি হামলায়। ভারত এর জন্য পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিদের দায়ী করে। পাকিস্তান অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
তথ্যসূত্র:
- রয়টার্স (মার্চ ২০২৫), “কাশ্মীরে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ ভারতের”
৪. কূটনৈতিক স্থবিরতা
২০২১ সালে ইউএই-এর মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া গোপন শান্তি আলোচনা ২০২৩ সালে ভেঙে পড়ে। ভারত তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্ক একেবারে জিম্মি হয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র:
- আল জাজিরা (২০২৩), “ভেঙে পড়ল গোপন ভারত-পাক আলোচনা”
- হিন্দুস্তান টাইমস (২০২৪), “কাশ্মীর নিয়ে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান ভারতের”
৫. ভৌগোলিক রাজনীতির পরিবর্তন
চীনের “চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর (CPEC)” প্রকল্প ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের উদ্বেগের কারণ। অন্যদিকে, ভারত QUAD জোটে (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান) সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে, যা পাকিস্তান ও চীনের দৃষ্টিতে ঘেরাও নীতির অংশ।
তথ্যসূত্র:
- কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস (২০২৪), “QUAD এর ভূরাজনৈতিক প্রভাব”
- ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন (২০২৪), “CPEC ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা”
পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছেই ১৫০-র বেশি পরমাণু অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস অনুযায়ী, সীমিত যুদ্ধও অনিচ্ছাকৃতভাবে পরমাণু যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একবার কাশ্মীরকে “বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান” বলে উল্লেখ করেছিলেন—এই সতর্কতা এখনও প্রাসঙ্গিক।
তথ্যসূত্র:
- Federation of American Scientists (২০২৪)
- বিবিসি (২০০০), “ক্লিনটন: কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান”
যুদ্ধ কি অনিবার্য?
যুদ্ধের আশঙ্কা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ সম্ভবত হবে না। অর্থনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং মানবিক ক্ষয়ক্ষতির ভয় দু’দেশকেই কিছুটা সংযত রেখেছে। তবে ছোটখাটো সংঘর্ষ বা জঙ্গি হামলার মাধ্যমে বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিতে পারে যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়।
সমাধানের পথ: কূটনীতি না সংঘাত?
টেকসই শান্তির জন্য জরুরি:
- যুদ্ধবিরতি চুক্তি (২০০৩) মেনে চলা
- Track-II কূটনীতি (শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বেসরকারি সংস্থা) সক্রিয় করা
- সীমান্তে সেনা গতিবিধিতে স্বচ্ছতা
- আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি
ভারত ও পাকিস্তানের সামনে এখন দুটি পথ: সংঘাতের দুষ্টচক্র চালিয়ে যাওয়া, না কি আলোচনার মাধ্যমে অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বিশ্ব তাকিয়ে আছে, এই দুই দেশের নেতৃত্ব কতটা দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারে তা দেখার জন্য।
Please Share This Post in Your Social Media

ভারত-পাকিস্তান: নতুন সংঘাতের পথে?

দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী—ভারত ও পাকিস্তান—আবারো উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে। উপমহাদেশে বহু দশকের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক, যুদ্ধ, এবং সীমান্ত সংঘর্ষের ইতিহাসকে মাথায় রেখেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন: আবার কি নতুন কোনো বড় সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান?
উত্তেজনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালের বিভাজনের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত। ১৯৪৭–৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধসহ মোট চারটি যুদ্ধ হয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে। এর মূল কেন্দ্রে রয়েছে কাশ্মীর বিরোধ, যা উভয় দেশের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের বিষয়।
২০১৯ সালে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করে। তারা এই সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করে।
তথ্যসূত্র:
- গাঙ্গুলী, শিবাজি ও কপূর, সুমিত (২০১০)। India, Pakistan, and the Bomb. কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস
- ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (২০১৯)। “৩৭০ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত বিবৃতি”
নতুন উত্তেজনার কারণসমূহ
১. সীমান্ত সংঘর্ষ
২০২১ সালের যুদ্ধবিরতির চুক্তি সত্ত্বেও ২০২৪ সালের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর গোলাগুলি বেড়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী বলছে, ১০০-র বেশি সংঘর্ষ হয়েছে শুধুমাত্র প্রথম তিন মাসেই। পাকিস্তানও ভারতকে উস্কানির জন্য দায়ী করেছে।
তথ্যসূত্র:
- ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন (২০২৪)
- পাকিস্তান আইএসপিআর প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২. রাজনৈতিক বক্তব্য ও জাতীয়তাবাদ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান দেখা গেছে, যেখানে “পাক-অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধারের” মত বক্তব্য উঠে এসেছে। এর জবাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সতর্ক করে বলেছে যে, তারা “উপযুক্ত জবাব” দেবে।
তথ্যসূত্র:
- দ্য হিন্দু (মার্চ ২০২৫), “পিএম মোদি: পাক-অধিকৃত কাশ্মীর আমাদের”
- ডন (মার্চ ২০২৫), “পাক সেনাবাহিনী: ভারতের বক্তব্য উস্কানিমূলক”
৩. কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ
কাশ্মীরের পুনচ জেলায় মার্চ ২০২৫ সালে পাঁচজন ভারতীয় সেনা নিহত হয় এক জঙ্গি হামলায়। ভারত এর জন্য পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিদের দায়ী করে। পাকিস্তান অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
তথ্যসূত্র:
- রয়টার্স (মার্চ ২০২৫), “কাশ্মীরে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ ভারতের”
৪. কূটনৈতিক স্থবিরতা
২০২১ সালে ইউএই-এর মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া গোপন শান্তি আলোচনা ২০২৩ সালে ভেঙে পড়ে। ভারত তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্ক একেবারে জিম্মি হয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র:
- আল জাজিরা (২০২৩), “ভেঙে পড়ল গোপন ভারত-পাক আলোচনা”
- হিন্দুস্তান টাইমস (২০২৪), “কাশ্মীর নিয়ে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান ভারতের”
৫. ভৌগোলিক রাজনীতির পরিবর্তন
চীনের “চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর (CPEC)” প্রকল্প ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের উদ্বেগের কারণ। অন্যদিকে, ভারত QUAD জোটে (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান) সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে, যা পাকিস্তান ও চীনের দৃষ্টিতে ঘেরাও নীতির অংশ।
তথ্যসূত্র:
- কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস (২০২৪), “QUAD এর ভূরাজনৈতিক প্রভাব”
- ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন (২০২৪), “CPEC ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা”
পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছেই ১৫০-র বেশি পরমাণু অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস অনুযায়ী, সীমিত যুদ্ধও অনিচ্ছাকৃতভাবে পরমাণু যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একবার কাশ্মীরকে “বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান” বলে উল্লেখ করেছিলেন—এই সতর্কতা এখনও প্রাসঙ্গিক।
তথ্যসূত্র:
- Federation of American Scientists (২০২৪)
- বিবিসি (২০০০), “ক্লিনটন: কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান”
যুদ্ধ কি অনিবার্য?
যুদ্ধের আশঙ্কা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ সম্ভবত হবে না। অর্থনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং মানবিক ক্ষয়ক্ষতির ভয় দু’দেশকেই কিছুটা সংযত রেখেছে। তবে ছোটখাটো সংঘর্ষ বা জঙ্গি হামলার মাধ্যমে বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিতে পারে যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়।
সমাধানের পথ: কূটনীতি না সংঘাত?
টেকসই শান্তির জন্য জরুরি:
- যুদ্ধবিরতি চুক্তি (২০০৩) মেনে চলা
- Track-II কূটনীতি (শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বেসরকারি সংস্থা) সক্রিয় করা
- সীমান্তে সেনা গতিবিধিতে স্বচ্ছতা
- আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি
ভারত ও পাকিস্তানের সামনে এখন দুটি পথ: সংঘাতের দুষ্টচক্র চালিয়ে যাওয়া, না কি আলোচনার মাধ্যমে অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বিশ্ব তাকিয়ে আছে, এই দুই দেশের নেতৃত্ব কতটা দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারে তা দেখার জন্য।