হাজার কোটির ‘মাফিয়া’ শেখ তাপসের অবস্থান ফাঁস করলেন সাবেক ডিবি প্রধান হারুন

- Update Time : ০৫:৪৫:৪৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫
- / ১০৩ Time View
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা প্রকট হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে একাধিক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, আবার অনেকেই গোপনে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। এই তালিকায় অন্যতম আলোচিত নাম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
সম্প্রতি শেখ তাপসের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এক গোপন কল রেকর্ড, যেখানে তার অবস্থান সিঙ্গাপুরে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ।
গোপন কল রেকর্ডে ফাঁস: শেখ তাপস আছেন সিঙ্গাপুরে
গত ৭ এপ্রিল, কানাডাভিত্তিক নাগরিক টিভির বার্তা প্রধান নাজমুস সাকিবের একটি প্রতিবেদনে সম্প্রচারিত হয় একটি অডিও কল রেকর্ড, যাতে হারুন অর রশিদকে বলতে শোনা যায়, “শেখ তাপস এখন সিঙ্গাপুরে আছেন।”
এই অডিওর মাধ্যমে জানা যায়, ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট, শেখ তাপস হঠাৎ করেই ঢাকা ছাড়েন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ার খবরে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেদিনই তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাজ্যে পাঠিয়ে দেন এবং নিজে রাতের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরে চলে যান। সেখানে তিনি এখনো অবস্থান করছেন, যদিও কোনো ভিসা ছাড়াই তিনি সিঙ্গাপুরে থাকার বিষয়টি নিয়ে উঠেছে নতুন প্রশ্ন।
তাপসের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
সাবেক মেয়র শেখ তাপসের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক গুরুতর অভিযোগ—হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ব্যাংক জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তদন্ত করছে। তার মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ফান্ড সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা তিনি দক্ষিণ সিটির অর্থ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ
তাপসকে ঘিরে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগটি এসেছে পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন আহমেদের কাছ থেকে। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালের ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শেখ তাপসসহ কয়েকজন রাজনীতিক জড়িত ছিলেন। যদিও এই অভিযোগ এখনও তদন্তাধীন, কিন্তু এই বক্তব্য নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা এবং গণমাধ্যমে সমালোচনা
২০২৩ সালে তাপস তখন আবার আলোচনায় আসেন যখন তিনি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি রম্য রচনাকে মানহানিকর দাবি করে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামসহ তিনজনের নামে আইনি নোটিশ পাঠান। এই ঘটনায় তাকে সামাজিক মাধ্যমে কটাক্ষ করে “১০০ কোটি টাকার মেয়র” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেই সময় দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের নেতারা এ ঘটনাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আঘাত হিসেবে দেখেন।
পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সমালোচনা
শুধু দুর্নীতি নয়, পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্তের কারণেও বিতর্কে জড়ান তাপস। ২০২৩ সালের শুরুতে রাজধানীর ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডে গভীর রাতে গাছ কাটার নির্দেশ দেন তিনি। এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলনের নেত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নগর ভবনে গিয়ে দেখা করতে চাইলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর শুরু হয় তীব্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভ, যা তাপসের জনপ্রিয়তায় বড় ধাক্কা দেয়।
নিজ দলের নেতার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নিজ দলেরই নেতা তাপসকে আক্রমণ করে বলেন, “তিনি (তাপস) মেয়র থাকার যোগ্য নন।” তার অভিযোগ, তাপস সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকা নিজের ব্যাংকে (মধুমতি ব্যাংক) স্থানান্তর করে সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঋণ আকারে দিয়ে নিজেই লাভবান হয়েছেন।
বিতর্কিত বক্তব্য: ‘চিফ জাস্টিসকে নামিয়ে দিয়েছি’
২০২৩ সালের মে মাসে, আরও একটি বিতর্কে জড়ান তাপস। এক সভায় তিনি বলেন, “মনটা চায় আবার ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি… একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম।” তিনি তখন বার কাউন্সিলের সাবেক সাব-কমিটি প্রধান মশিউজ্জামানকে “সবচেয়ে বড় চোর” বলে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন, “যে সকল সুশীলরা বুদ্ধি দিতে আসবে, তাদের বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেবো।” এই বক্তব্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় তোলে এবং আইনি জটিলতাও তৈরি হয়।
তাপস এখনো আলোচনার কেন্দ্রে
শেখ ফজলে নূর তাপস এখন বিদেশে আত্মগোপনে থাকলেও তার নাম ঘিরে বিতর্ক থেমে নেই। সরকারের পরিবর্তনের পর তিনি আবার রাজনৈতিক ময়দানে ফিরতে পারেন—এমন গুঞ্জন চলছে। তবে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ রাজনীতি যে চরম প্রশ্নের মুখে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এক সময়ের প্রভাবশালী এই মেয়রের বর্তমান অবস্থান ফাঁস হওয়ায় আবারো সামনে চলে এসেছে তার পুরনো কেলেঙ্কারিগুলোর ফিরিস্তি—যা দেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
Please Share This Post in Your Social Media

হাজার কোটির ‘মাফিয়া’ শেখ তাপসের অবস্থান ফাঁস করলেন সাবেক ডিবি প্রধান হারুন

আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা প্রকট হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে একাধিক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, আবার অনেকেই গোপনে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। এই তালিকায় অন্যতম আলোচিত নাম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
সম্প্রতি শেখ তাপসের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এক গোপন কল রেকর্ড, যেখানে তার অবস্থান সিঙ্গাপুরে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ।
গোপন কল রেকর্ডে ফাঁস: শেখ তাপস আছেন সিঙ্গাপুরে
গত ৭ এপ্রিল, কানাডাভিত্তিক নাগরিক টিভির বার্তা প্রধান নাজমুস সাকিবের একটি প্রতিবেদনে সম্প্রচারিত হয় একটি অডিও কল রেকর্ড, যাতে হারুন অর রশিদকে বলতে শোনা যায়, “শেখ তাপস এখন সিঙ্গাপুরে আছেন।”
এই অডিওর মাধ্যমে জানা যায়, ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট, শেখ তাপস হঠাৎ করেই ঢাকা ছাড়েন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ার খবরে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেদিনই তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাজ্যে পাঠিয়ে দেন এবং নিজে রাতের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরে চলে যান। সেখানে তিনি এখনো অবস্থান করছেন, যদিও কোনো ভিসা ছাড়াই তিনি সিঙ্গাপুরে থাকার বিষয়টি নিয়ে উঠেছে নতুন প্রশ্ন।
তাপসের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
সাবেক মেয়র শেখ তাপসের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক গুরুতর অভিযোগ—হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ব্যাংক জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তদন্ত করছে। তার মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ফান্ড সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা তিনি দক্ষিণ সিটির অর্থ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ
তাপসকে ঘিরে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগটি এসেছে পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন আহমেদের কাছ থেকে। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালের ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শেখ তাপসসহ কয়েকজন রাজনীতিক জড়িত ছিলেন। যদিও এই অভিযোগ এখনও তদন্তাধীন, কিন্তু এই বক্তব্য নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা এবং গণমাধ্যমে সমালোচনা
২০২৩ সালে তাপস তখন আবার আলোচনায় আসেন যখন তিনি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি রম্য রচনাকে মানহানিকর দাবি করে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামসহ তিনজনের নামে আইনি নোটিশ পাঠান। এই ঘটনায় তাকে সামাজিক মাধ্যমে কটাক্ষ করে “১০০ কোটি টাকার মেয়র” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেই সময় দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের নেতারা এ ঘটনাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আঘাত হিসেবে দেখেন।
পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সমালোচনা
শুধু দুর্নীতি নয়, পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্তের কারণেও বিতর্কে জড়ান তাপস। ২০২৩ সালের শুরুতে রাজধানীর ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডে গভীর রাতে গাছ কাটার নির্দেশ দেন তিনি। এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলনের নেত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নগর ভবনে গিয়ে দেখা করতে চাইলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর শুরু হয় তীব্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভ, যা তাপসের জনপ্রিয়তায় বড় ধাক্কা দেয়।
নিজ দলের নেতার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নিজ দলেরই নেতা তাপসকে আক্রমণ করে বলেন, “তিনি (তাপস) মেয়র থাকার যোগ্য নন।” তার অভিযোগ, তাপস সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকা নিজের ব্যাংকে (মধুমতি ব্যাংক) স্থানান্তর করে সেগুলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঋণ আকারে দিয়ে নিজেই লাভবান হয়েছেন।
বিতর্কিত বক্তব্য: ‘চিফ জাস্টিসকে নামিয়ে দিয়েছি’
২০২৩ সালের মে মাসে, আরও একটি বিতর্কে জড়ান তাপস। এক সভায় তিনি বলেন, “মনটা চায় আবার ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি… একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম।” তিনি তখন বার কাউন্সিলের সাবেক সাব-কমিটি প্রধান মশিউজ্জামানকে “সবচেয়ে বড় চোর” বলে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন, “যে সকল সুশীলরা বুদ্ধি দিতে আসবে, তাদের বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেবো।” এই বক্তব্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় তোলে এবং আইনি জটিলতাও তৈরি হয়।
তাপস এখনো আলোচনার কেন্দ্রে
শেখ ফজলে নূর তাপস এখন বিদেশে আত্মগোপনে থাকলেও তার নাম ঘিরে বিতর্ক থেমে নেই। সরকারের পরিবর্তনের পর তিনি আবার রাজনৈতিক ময়দানে ফিরতে পারেন—এমন গুঞ্জন চলছে। তবে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ রাজনীতি যে চরম প্রশ্নের মুখে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এক সময়ের প্রভাবশালী এই মেয়রের বর্তমান অবস্থান ফাঁস হওয়ায় আবারো সামনে চলে এসেছে তার পুরনো কেলেঙ্কারিগুলোর ফিরিস্তি—যা দেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।