পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতির অবসান এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগতি

- Update Time : ১২:৫৯:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১২৩ Time View
দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতি অবশেষে বন্ধ হয়েছে। এই সংস্কৃতি মূলত ছাত্র সংগঠনগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হয়ে উঠেছিল, যেখানে নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রিত নির্যাতনের শিকার হতে হত। বিশেষত, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অধীনে এই সংস্কৃতি আরও কঠোর ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিকভাবে দমন করার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত এই ‘গেস্টরুম’ প্রথার মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করা হতো। অনেক শিক্ষার্থীই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতো, যেখানে তারা নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুক্তচিন্তার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
তবে, অবশেষে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিনের এই দমনমূলক সংস্কৃতির অবসানকে স্বাগত জানিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করার পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখন শুধুমাত্র ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতির অবসানেই থেমে নেই; তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এই নির্বাচন পুনরায় চালু হলে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রকাশের আরও স্বাধীন সুযোগ তৈরি হবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুদ্ধার হবে বলে তারা মনে করছে। ছাত্ররাজনীতিতে গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার সুরক্ষিত করতে তারা প্রশাসন ও সরকারের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো একসময় ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলে ছিল। হল প্রশাসন কার্যত দলীয় প্রভাবের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা হতো, যেখানে মানবেতর পরিবেশে তাদের দিন কাটাতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো, যা শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকেই তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াত। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল, এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হতো না।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর এই চিত্র অনেকটাই বদলে যায়। নতুন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর হলগুলোতে রাজনৈতিক গণরুমের ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এবং শিক্ষার্থীদের আসন বণ্টনের জন্য মেধা ও প্রয়োজনভিত্তিক একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করে। গেস্টরুম নির্যাতন, যা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য আতঙ্কের বিষয় ছিল, সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। তবে, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের মধ্যে এখনও ক্যান্টিনের নিম্নমানের খাবার অন্যতম সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। নতুন প্রশাসন শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও আবাসিক সুবিধার মানোন্নয়নে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে।
এছাড়া, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও আবার ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসে ফিরে আসছে। টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা ও বিভিন্ন মুক্ত স্থানে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রশিবির তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দীর্ঘদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দুটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিগুলো বর্তমানে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সামগ্রিকভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় প্রশাসনকে আরও সচেষ্ট হতে হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে মত প্রকাশ করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা হয়, যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল প্রবল, এবং শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হতেন। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলকভাবে অংশগ্রহণ করতে হতো। তবে এই ঘটনার পর পরিস্থিতির劇তর পরিবর্তন ঘটে, এবং শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য আসন বুঝে পেতে শুরু করেন। ফলে ক্যাম্পাসে গণরুম সংস্কৃতির অবসান ঘটে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অপেক্ষাকৃত স্বাধীন পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা রাজনৈতিক দখলদারিত্বের অবসান ঘটে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পান। নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং জোরপূর্বক রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা কমে আসে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরিয়ে আনে। প্রশাসনের উদ্যোগে এখন শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ও অন্যান্য সুবিধা পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে, যাতে প্রকৃত মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে আসন বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অনুযায়ী, আগের তুলনায় হল ও ক্লাসরুমের পরিবেশ উন্নত হয়েছে, তবে ক্যান্টিনের খাবারের মান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এখনও কিছু সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি। দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা এই নির্বাচন পুনরায় চালু করতে প্রশাসন ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে এবং চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন তফসিল ঘোষণার কথা ছিল, ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠনের আপত্তির কারণে সেটি এখনো ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে, এবং শিক্ষার্থীরা একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হয়েছে, তবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণে প্রশাসনকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল ছিল। প্রায়ই সংঘর্ষের ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হতেন এবং ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হতো। শিক্ষার্থীদের আবাসন ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট, যেখানে নিরপেক্ষ বা অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে এই দখলদারত্বের অবসান ঘটে, এবং শিক্ষার্থীরা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ভিত্তিতে হলগুলোতে আসন বরাদ্দ দিচ্ছে, যা আগে রাজনৈতিক পরিচয় বা ছাত্রসংগঠনের আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। ফলে প্রকৃত মেধাবীদের জন্য অধিক সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এর পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা ও দখলদারিত্বের সংস্কৃতি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, যা একসময় শিক্ষার্থীদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ ছিল। শিক্ষার্থীরা এখন পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও স্বতন্ত্র কার্যক্রমে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এই নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চান, যাতে প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি, একটি কার্যকর ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা—যেমন ক্যান্টিনের খাবারের মান, পরিবহন সংকট, আবাসিক সুবিধার ঘাটতি ইত্যাদি—সমাধান করা সম্ভব হবে। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো ঘোষণা আসেনি, শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এবং একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলদারিত্ব ছিল, বিশেষ করে ছাত্রাবাসগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা সিট-বাণিজ্য চালিয়ে আসছিল এবং শিক্ষার্থীদের উপর নানা ধরনের দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করত। রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কারণে অনেক শিক্ষার্থী তাদের আসন বা আবাসন সুবিধা পেতেন না, এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর প্রশাসন পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ নেয়। এখন শিক্ষার্থীদের আবেদন গ্রহণের মাধ্যমে এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে হলে আসন বরাদ্দ করা হচ্ছে, যা অনেকটাই মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে। এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির এখনও প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য সেবা এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী দীর্ঘ সেশনজটে আটকে আছেন, যা তাদের শিক্ষা জীবনে প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও, ক্যান্টিনের খাবারের মান এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি নিয়েও অভিযোগ উঠছে। প্রশাসন এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দ্রুত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না, যার ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশ। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও মনোযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চলতি মাস ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাচন বন্ধ ছিল, এবং শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। তবে নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপের জন্য শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র
অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেমন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দখলদারিত্বের অবসান ঘটতে দেখছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এর মধ্যে একক কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা কমে এসেছে এবং শিক্ষার্থীরা একটি মুক্ত পরিবেশে তাদের শৈক্ষিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী ছাত্রদের অবস্থান ও কার্যক্রম আগের তুলনায় আরও বেশি স্বাধীন হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, যদিও রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুটা কমেছে, তবে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট আরও প্রকট হয়েছে এবং শিক্ষক সংকটও এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিকভাবে ক্লাস চালানো এবং ক্যাম্পাসে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এসব সমস্যা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন এবং প্রশাসনও তাদের দাবিগুলো নিয়ে কাজ করছে, যার ফলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির পটভূমি
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল, যা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। শেষবার ১৯৯০-এর দশকে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা স্থগিত হয়ে পড়ে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারছিল না, এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের চাহিদা বা অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ প্রতিকার পেতে পারছিল না। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল, কারণ তাদের মতামত ও দাবির কোনো পটভূমি ছিল না। তবে ৫ আগস্টের পর, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে, যা গণতান্ত্রিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে এটি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি জবাবদিহিতা তৈরি করবে। শিক্ষার্থীদের একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ থাকবে, যা তাদের শিক্ষা ও ক্যাম্পাস জীবনকে আরও কার্যকর এবং সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া, ছাত্র সংসদ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, কারণ এর মাধ্যমে তারা নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদের নেতৃত্বের ভূমিকা প্রস্তুত করতে পারবে। ফলে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
শেষকথা,গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর দখলদারত্বের সমাপ্তি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় অর্জন। তবে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার জন্য এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পূরণ করতে হবে, যাতে গণতান্ত্রিক শিক্ষার পরিবেশ আরও সুসংহত হয়।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
Please Share This Post in Your Social Media

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতির অবসান এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগতি

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতি অবশেষে বন্ধ হয়েছে। এই সংস্কৃতি মূলত ছাত্র সংগঠনগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হয়ে উঠেছিল, যেখানে নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রিত নির্যাতনের শিকার হতে হত। বিশেষত, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অধীনে এই সংস্কৃতি আরও কঠোর ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিকভাবে দমন করার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত এই ‘গেস্টরুম’ প্রথার মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করা হতো। অনেক শিক্ষার্থীই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতো, যেখানে তারা নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুক্তচিন্তার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
তবে, অবশেষে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিনের এই দমনমূলক সংস্কৃতির অবসানকে স্বাগত জানিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করার পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখন শুধুমাত্র ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতির অবসানেই থেমে নেই; তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এই নির্বাচন পুনরায় চালু হলে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রকাশের আরও স্বাধীন সুযোগ তৈরি হবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুদ্ধার হবে বলে তারা মনে করছে। ছাত্ররাজনীতিতে গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার সুরক্ষিত করতে তারা প্রশাসন ও সরকারের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো একসময় ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলে ছিল। হল প্রশাসন কার্যত দলীয় প্রভাবের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা হতো, যেখানে মানবেতর পরিবেশে তাদের দিন কাটাতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো, যা শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকেই তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াত। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল, এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হতো না।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর এই চিত্র অনেকটাই বদলে যায়। নতুন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর হলগুলোতে রাজনৈতিক গণরুমের ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এবং শিক্ষার্থীদের আসন বণ্টনের জন্য মেধা ও প্রয়োজনভিত্তিক একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করে। গেস্টরুম নির্যাতন, যা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য আতঙ্কের বিষয় ছিল, সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। তবে, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের মধ্যে এখনও ক্যান্টিনের নিম্নমানের খাবার অন্যতম সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। নতুন প্রশাসন শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও আবাসিক সুবিধার মানোন্নয়নে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে।
এছাড়া, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও আবার ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসে ফিরে আসছে। টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা ও বিভিন্ন মুক্ত স্থানে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রশিবির তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দীর্ঘদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দুটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিগুলো বর্তমানে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সামগ্রিকভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় প্রশাসনকে আরও সচেষ্ট হতে হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে মত প্রকাশ করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা হয়, যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল প্রবল, এবং শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হতেন। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলকভাবে অংশগ্রহণ করতে হতো। তবে এই ঘটনার পর পরিস্থিতির劇তর পরিবর্তন ঘটে, এবং শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য আসন বুঝে পেতে শুরু করেন। ফলে ক্যাম্পাসে গণরুম সংস্কৃতির অবসান ঘটে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অপেক্ষাকৃত স্বাধীন পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা রাজনৈতিক দখলদারিত্বের অবসান ঘটে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পান। নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং জোরপূর্বক রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা কমে আসে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরিয়ে আনে। প্রশাসনের উদ্যোগে এখন শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ও অন্যান্য সুবিধা পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে, যাতে প্রকৃত মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে আসন বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অনুযায়ী, আগের তুলনায় হল ও ক্লাসরুমের পরিবেশ উন্নত হয়েছে, তবে ক্যান্টিনের খাবারের মান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এখনও কিছু সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি। দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা এই নির্বাচন পুনরায় চালু করতে প্রশাসন ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে এবং চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন তফসিল ঘোষণার কথা ছিল, ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠনের আপত্তির কারণে সেটি এখনো ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে, এবং শিক্ষার্থীরা একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হয়েছে, তবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণে প্রশাসনকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল ছিল। প্রায়ই সংঘর্ষের ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হতেন এবং ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হতো। শিক্ষার্থীদের আবাসন ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট, যেখানে নিরপেক্ষ বা অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে এই দখলদারত্বের অবসান ঘটে, এবং শিক্ষার্থীরা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ভিত্তিতে হলগুলোতে আসন বরাদ্দ দিচ্ছে, যা আগে রাজনৈতিক পরিচয় বা ছাত্রসংগঠনের আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। ফলে প্রকৃত মেধাবীদের জন্য অধিক সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এর পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা ও দখলদারিত্বের সংস্কৃতি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, যা একসময় শিক্ষার্থীদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ ছিল। শিক্ষার্থীরা এখন পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও স্বতন্ত্র কার্যক্রমে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এই নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চান, যাতে প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি, একটি কার্যকর ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা—যেমন ক্যান্টিনের খাবারের মান, পরিবহন সংকট, আবাসিক সুবিধার ঘাটতি ইত্যাদি—সমাধান করা সম্ভব হবে। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো ঘোষণা আসেনি, শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এবং একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলদারিত্ব ছিল, বিশেষ করে ছাত্রাবাসগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা সিট-বাণিজ্য চালিয়ে আসছিল এবং শিক্ষার্থীদের উপর নানা ধরনের দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করত। রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কারণে অনেক শিক্ষার্থী তাদের আসন বা আবাসন সুবিধা পেতেন না, এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর প্রশাসন পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ নেয়। এখন শিক্ষার্থীদের আবেদন গ্রহণের মাধ্যমে এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে হলে আসন বরাদ্দ করা হচ্ছে, যা অনেকটাই মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে। এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির এখনও প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য সেবা এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী দীর্ঘ সেশনজটে আটকে আছেন, যা তাদের শিক্ষা জীবনে প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও, ক্যান্টিনের খাবারের মান এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি নিয়েও অভিযোগ উঠছে। প্রশাসন এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দ্রুত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না, যার ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশ। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও মনোযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চলতি মাস ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাচন বন্ধ ছিল, এবং শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। তবে নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপের জন্য শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র
অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেমন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দখলদারিত্বের অবসান ঘটতে দেখছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এর মধ্যে একক কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা কমে এসেছে এবং শিক্ষার্থীরা একটি মুক্ত পরিবেশে তাদের শৈক্ষিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী ছাত্রদের অবস্থান ও কার্যক্রম আগের তুলনায় আরও বেশি স্বাধীন হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, যদিও রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুটা কমেছে, তবে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট আরও প্রকট হয়েছে এবং শিক্ষক সংকটও এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিকভাবে ক্লাস চালানো এবং ক্যাম্পাসে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এসব সমস্যা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন এবং প্রশাসনও তাদের দাবিগুলো নিয়ে কাজ করছে, যার ফলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির পটভূমি
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল, যা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। শেষবার ১৯৯০-এর দশকে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা স্থগিত হয়ে পড়ে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারছিল না, এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের চাহিদা বা অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ প্রতিকার পেতে পারছিল না। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল, কারণ তাদের মতামত ও দাবির কোনো পটভূমি ছিল না। তবে ৫ আগস্টের পর, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে, যা গণতান্ত্রিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে এটি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি জবাবদিহিতা তৈরি করবে। শিক্ষার্থীদের একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ থাকবে, যা তাদের শিক্ষা ও ক্যাম্পাস জীবনকে আরও কার্যকর এবং সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া, ছাত্র সংসদ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, কারণ এর মাধ্যমে তারা নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদের নেতৃত্বের ভূমিকা প্রস্তুত করতে পারবে। ফলে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
শেষকথা,গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর দখলদারত্বের সমাপ্তি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় অর্জন। তবে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার জন্য এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পূরণ করতে হবে, যাতে গণতান্ত্রিক শিক্ষার পরিবেশ আরও সুসংহত হয়।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো