সময়: মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

ভারতে মহাকুম্ভে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত মসজিদ ও মাদ্রাসা

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৫:১৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ১২৫ Time View

MOHAKUMBO

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

ভারতে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়লেও, সংকটকালে মানুষের প্রতি মানবিকতার হাত বাড়ানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেছে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ) আয়োজিত মহাকুম্ভ মেলায়। ২৯ জানুয়ারি পদদলিত হওয়ার ঘটনার পর হাজারো বিপন্ন ও ক্ষুধার্ত তীর্থযাত্রীদের জন্য প্রয়াগরাজের মুসলিম সম্প্রদায় তাঁদের মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইমামবাড়ার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। অথচ, কুম্ভমেলার সময় শহরের বহু এলাকায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ রাখার অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

সংকটকালে মানবিকতার হাত প্রসারিত

শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, স্থানীয় মুসলিমরা তাঁদের নিজ বাড়ির দরজাও অসহায় তীর্থযাত্রীদের জন্য খুলে দেন। অনেক পরিবার নিরামিষ খাবার রান্না করে বিতরণ করে, যার মধ্যে ছিল পুরি, সবজি, খিচুড়ি, গরম চা এবং শীত নিবারণের জন্য কম্বল। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

প্রয়াগরাজের সংস্কৃতি: গঙ্গাযামনি তেহজিব

এই মানবিক দৃষ্টান্ত গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। স্থানীয় মুসলিমরা জানান, এটি প্রয়াগরাজের ঐতিহ্য, যা ‘গঙ্গা-যামনি তেহজিব’ নামে পরিচিত। বহুকাল ধরে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই ঐতিহ্য স্থানীয় মানুষদের একে অপরের সহায়তায় এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।

অন্যান্য অঞ্চলেও উদাহরণ

এ ধরনের মানবিকতা শুধু প্রয়াগরাজে নয়, ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও দেখা গেছে। সম্প্রতি, কাশ্মীরে বরফে আটকে পড়া পর্যটকদের উদ্ধার করে স্থানীয় মুসলিমরা মসজিদে আশ্রয় দেন এবং উদ্ধারকারী দল আসা পর্যন্ত তাঁদের খাবার ও পানীয় সরবরাহ করেন। এছাড়া, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্যোগে দুর্যোগকালে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত দেখা গেছে।

মহাকুম্ভের সময়কার আশ্রয় কেন্দ্র

প্রয়াগরাজের খুল্লাবাদ সবজি মন্ডি মসজিদ, বড়া তাজিয়া ইমামবাড়া, হিম্মতগঞ্জ দরগাহ, চক মসজিদসহ বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি অসহায় তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। নখসখোলা অঞ্চলের হাফিজ রাজ্জাব মসজিদ ও চক এলাকার জামে মসজিদে অন্তত ৫০০ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়। মুসলিম অধ্যুষিত রোশনবাগ, খুল্লাবাদ, রানি মান্ডি, শাহগঞ্জ এলাকার বাসিন্দারাও রাজস্থান, তামিলনাড়ু, বিহার ও হরিয়ানা থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের জন্য তাঁদের ঘরের দরজা খুলে দেন।

নারীদের অবদান খাদ্য বিতরণ

স্থানীয় পরিবারের নারীরাও সক্রিয়ভাবে খাদ্য সরবরাহে অংশ নেন এবং অনেক স্থানে সেই রাতেই ভান্ডারা বা লঙ্গরের আয়োজন করা হয়। মুসলিমদের পাশাপাশি, শিখ সম্প্রদায়ও তাঁদের গুরুদ্বারের দরজা উন্মুক্ত করে অসহায় মানুষদের জন্য। অনেক মন্দিরেও তীর্থযাত্রীদের খাদ্য ও পানীয় বিতরণ করা হয়, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা

এ বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষক মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘হিন্দু তীর্থযাত্রীরা তাঁদের ধর্ম পালনের জন্য প্রয়াগে এসেছেন। তাঁদের বিপদে আমরা মানবতার চর্চা করেছি, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’ চক এলাকার বাসিন্দা মইনুদ্দিন জানান, ‘মানুষের বিপদে এগিয়ে আসাই আমাদের শৈশব থেকে শেখা মূল্যবোধ।’

সামাজিক বাধা বাস্তবতা

খুল্লাবাদের বাসিন্দা মাহমুদ আজম বলেন, ‘মহাকুম্ভ শুরুর আগেই মুসলিমদের মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছিল। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, কুম্ভমেলা মুসলিমদের মহল্লাতেই এসে পৌঁছেছে, আর আমরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।’ বাস্তবতা হলো, সংকটময় মুহূর্তে ধর্মীয় বিভাজন ম্লান হয়ে যায়, আর মানবিকতা তার স্থান নেয়।

সার্বিক শিক্ষা ভবিষ্যতের বার্তা

এই ঘটনা প্রমাণ করে, ধর্মীয় বিভাজন থাকলেও মানবিকতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সংকটকালে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবধর্মের প্রকাশ। ভবিষ্যতে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মানবিকতার এই চর্চা আরও প্রসারিত হবে বলেই আশা করা যায়।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

ভারতে মহাকুম্ভে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত মসজিদ ও মাদ্রাসা

Update Time : ০৫:১৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

ভারতে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়লেও, সংকটকালে মানুষের প্রতি মানবিকতার হাত বাড়ানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেছে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ) আয়োজিত মহাকুম্ভ মেলায়। ২৯ জানুয়ারি পদদলিত হওয়ার ঘটনার পর হাজারো বিপন্ন ও ক্ষুধার্ত তীর্থযাত্রীদের জন্য প্রয়াগরাজের মুসলিম সম্প্রদায় তাঁদের মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইমামবাড়ার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। অথচ, কুম্ভমেলার সময় শহরের বহু এলাকায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ রাখার অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

সংকটকালে মানবিকতার হাত প্রসারিত

শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, স্থানীয় মুসলিমরা তাঁদের নিজ বাড়ির দরজাও অসহায় তীর্থযাত্রীদের জন্য খুলে দেন। অনেক পরিবার নিরামিষ খাবার রান্না করে বিতরণ করে, যার মধ্যে ছিল পুরি, সবজি, খিচুড়ি, গরম চা এবং শীত নিবারণের জন্য কম্বল। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

প্রয়াগরাজের সংস্কৃতি: গঙ্গাযামনি তেহজিব

এই মানবিক দৃষ্টান্ত গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। স্থানীয় মুসলিমরা জানান, এটি প্রয়াগরাজের ঐতিহ্য, যা ‘গঙ্গা-যামনি তেহজিব’ নামে পরিচিত। বহুকাল ধরে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই ঐতিহ্য স্থানীয় মানুষদের একে অপরের সহায়তায় এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।

অন্যান্য অঞ্চলেও

উদাহরণ

এ ধরনের মানবিকতা শুধু প্রয়াগরাজে নয়, ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও দেখা গেছে। সম্প্রতি, কাশ্মীরে বরফে আটকে পড়া পর্যটকদের উদ্ধার করে স্থানীয় মুসলিমরা মসজিদে আশ্রয় দেন এবং উদ্ধারকারী দল আসা পর্যন্ত তাঁদের খাবার ও পানীয় সরবরাহ করেন। এছাড়া, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্যোগে দুর্যোগকালে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত দেখা গেছে।

মহাকুম্ভের সময়কার আশ্রয় কেন্দ্র

প্রয়াগরাজের খুল্লাবাদ সবজি মন্ডি মসজিদ, বড়া তাজিয়া ইমামবাড়া, হিম্মতগঞ্জ দরগাহ, চক মসজিদসহ বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি অসহায় তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। নখসখোলা অঞ্চলের হাফিজ রাজ্জাব মসজিদ ও চক এলাকার জামে মসজিদে অন্তত ৫০০ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়। মুসলিম অধ্যুষিত রোশনবাগ, খুল্লাবাদ, রানি মান্ডি, শাহগঞ্জ এলাকার বাসিন্দারাও রাজস্থান, তামিলনাড়ু, বিহার ও হরিয়ানা থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের জন্য তাঁদের ঘরের দরজা খুলে দেন।

নারীদের অবদান খাদ্য বিতরণ

স্থানীয় পরিবারের নারীরাও সক্রিয়ভাবে খাদ্য সরবরাহে অংশ নেন এবং অনেক স্থানে সেই রাতেই ভান্ডারা বা লঙ্গরের আয়োজন করা হয়। মুসলিমদের পাশাপাশি, শিখ সম্প্রদায়ও তাঁদের গুরুদ্বারের দরজা উন্মুক্ত করে অসহায় মানুষদের জন্য। অনেক মন্দিরেও তীর্থযাত্রীদের খাদ্য ও পানীয় বিতরণ করা হয়, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা

এ বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষক মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘হিন্দু তীর্থযাত্রীরা তাঁদের ধর্ম পালনের জন্য প্রয়াগে এসেছেন। তাঁদের বিপদে আমরা মানবতার চর্চা করেছি, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’ চক এলাকার বাসিন্দা মইনুদ্দিন জানান, ‘মানুষের বিপদে এগিয়ে আসাই আমাদের শৈশব থেকে শেখা মূল্যবোধ।’

সামাজিক বাধা বাস্তবতা

খুল্লাবাদের বাসিন্দা মাহমুদ আজম বলেন, ‘মহাকুম্ভ শুরুর আগেই মুসলিমদের মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছিল। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, কুম্ভমেলা মুসলিমদের মহল্লাতেই এসে পৌঁছেছে, আর আমরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।’ বাস্তবতা হলো, সংকটময় মুহূর্তে ধর্মীয় বিভাজন ম্লান হয়ে যায়, আর মানবিকতা তার স্থান নেয়।

সার্বিক শিক্ষা ভবিষ্যতের বার্তা

এই ঘটনা প্রমাণ করে, ধর্মীয় বিভাজন থাকলেও মানবিকতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সংকটকালে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবধর্মের প্রকাশ। ভবিষ্যতে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মানবিকতার এই চর্চা আরও প্রসারিত হবে বলেই আশা করা যায়।

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share