সময়: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

হাসিনার আমলে দাঁত-নখ-থাবা হারানো বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) কি স্বাধীন ও কার্যকর সংস্থা হিসাবে কাজ করে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে?   

বিল্লাল হোসেন
  • Update Time : ০৯:২১:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ১২৮ Time View

bd anti corruption

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের মহান উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হল সমাজের সর্বস্তরে একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার ঘটানো। কমিশনের আইন অনুযায়ী, এটি একটি স্বাধীন, স্বশাসিত ও নিরপেক্ষ সংস্থা হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কমিশন কতটুকু স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে যে ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, কয়েক মাস আগে তাকে দুদকের দায়ের করা মামলায় লোহার খাঁচার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, যা তার জন্য সর্বোচ্চ অসম্মানজনক ছিল।

দুদকের আইনজীবীরা যে মরিয়া হয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে লেগেছিল, তা অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে জানা নেই। সম্প্রতি, ৪ঠা সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও চার মামলার প্রস্তুতি ছিল দুদকে’ শিরোনামে সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগের মামলাটিও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসক্রিপশন পালনের অংশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকে দুদক ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, দুদক কী প্রতিক্রিয়া জানাবে? তারা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার বিষয়।  

এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করবে? কমিশনের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, অন্যথায় এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।

অপরাধ দমনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাকে যেন সরকার দাঁত-নখ-থাবা হারানো বাঘে পরিণত না করে, তার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে গোপাল হিসেবে সবকিছু দেখেছে। আকর্ষণীয় বিষয় হল, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুদক আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছে। সংস্কারের অভাব থাকলে ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে। গত মাসের শেষের দিকে দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টিআইবি ৫৫ দফার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে, যার মধ্যে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

সেনাসমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, দুর্নীতি দমন কমিশনে যোগদানের সময় তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দুদককে নখদন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, বাঘের নখ কেটে দেয়ার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা হ্রাসের প্রক্রিয়া চলছে। মেয়াদ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদায়কালে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনে ব্যর্থতার জন্য দুঃখ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একযুগ পর, মহামারি করোনাকালে ২০২১ সালে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করে বলে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে দন্তহীন বাঘের মতো আচরণ করা উচিত নয়। একই বছর, বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুদককে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, জনগণের আস্থা অর্জনে সেভাবে সফল হননি। যদি দুদকের চেয়ারম্যানরাই তাদের কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তাহলে এটি স্পষ্ট যে ‘ডালে কিছু কালো আছে’।

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, আন্দোলনকারী ছাত্রদের চাহিদার প্রতিফলন হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে নজর দিচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের সময়কালীন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়গুলো এখন গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ কাজে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান যদি সফলভাবে নখদন্তহীন দুদককে সংস্কার করতে পারেন, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কোথায় নিয়ে যেতে পারবেন এই প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে তাঁর হাত ধরে দুদকের কার্যক্রমে একটি নতুন দিক প্রবাহিত হওয়ার আশা করা যায়। এর মধ্যে, দুদকের বর্তমান কার্যক্রমের দিকনির্দেশনা কী, তা জানার আগে এর প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

দুদক প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি রোধ করা, কিন্তু এটি কার্যত অনেক সময় নখহীন বাঘের মতো হয়ে পড়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, যদি কমিশন যথাযথ সংস্কার না হয়, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। ড. ইফতেখারুজ্জামান যদি সংস্কারের মাধ্যমে কমিশনকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হন, তাহলে তা রাষ্ট্রের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তৈরি করবে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই উদ্যোগের ফলে জনগণের মধ্যে আশা জাগাতে পারে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং গণমানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওই সরকার দুর্নীতিবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তৎপর ছিল, যা সাধারণ মানুষের (যারা রাজনীতির বাইরে) একটি বড় অংশের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তখন দেড় শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয় এবং অনেককেই জেলে পাঠানো হয়।

এক-এগারোর পরিস্থিতিতে ড. ফখরুদ্দীন সরকারের সময়ে দুদক তার ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অজ্ঞাত কারণে দুদকের কার্যক্রম আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে। কমিশন তখন শুধুমাত্র চুনোপুঁটি ধরার উদ্দেশ্যে লোকদেখানো কাজে ব্যস্ত ছিল। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন সরকারের বড় ধরনের নেতারা দুদককে গুরুত্ব না দিয়ে ১৫টি বছর অতিক্রম করেছেন, যা প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ও জনগণের আস্থার জন্য একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন দুদক তার উদ্দেশ্য থেকে সরে গেল এবং কীভাবে এটি পুনরায় দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে? জনগণের কাছে দুদকের সঠিক ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি, নইলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

মোটামুটিভাবে বলা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করলেও অতীতের বিভিন্ন সরকার তাদের ইচ্ছেমাফিক প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদকের কার্যক্রমে বিগত সরকারের কোনো আড়ালে থাকা প্রভাব ছিল কি না। আসলে, দুদক কি সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে?

যদি দুদক আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণিত হয়, তবে এর পেছনে দায়ী কর্মকর্তা কে বা কারা? এত বড় প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক কর্মকর্তা নিশ্চয়ই রয়েছেন, যারা টিকে থাকার জন্য সরকারের ইশারা-ইঙ্গিতে কাজ করে থাকতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে, দুদকের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যদি কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ সরকারী চাপের মুখে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হন, তবে তা জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করবে এবং দুর্নীতি দমনে কমিশনের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং এর স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

সরকারের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর বজায় রাখা যায়, তা বোঝার জন্য কিছু দুর্বল আইন বা বিধি লক্ষ্য করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ক্রমিক নং ২৪-এ একদিকে বলা হয়েছে যে, “এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।” অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭-এর অষ্টম অধ্যায় উল্লেখ করেছে যে, “কমিশন ইহার নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে প্রেষণে অন্যত্র নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করিতে পারিবে, এবং সরকার উক্তরূপভাবে অনুরোধপ্রাপ্ত হলে উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে প্রেষণে নিয়োগ করিতে পারিবে।”

একই অধ্যায় আরও বলছে যে, “কমিশন ইহার দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের অধীন সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রেষণে নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করিতে পারিবে।” উপরোক্ত বিধিমালাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল যে, সরকার অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দুদকে পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে পারে এবং অপছন্দের ব্যক্তিদের সরিয়ে দিতে পারে।

এই কারণে, এ ধরনের বিধিমালা দুদকের ‘স্বাধীনতা’ শব্দের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হচ্ছে। যদি কমিশনের কার্যক্রমে সরকার প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়, তবে কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য, আইন ও বিধিগুলোর পুনর্বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে কমিশন সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) আইনে কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য যে বাছাই কমিটির উল্লেখ রয়েছে, সেখানে নিরপেক্ষ ও দক্ষ কমিশনার নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি সুগম নয়। বিশেষ করে, যদি এই বাছাই কমিটিতে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বা একটি নিরপেক্ষ ও খ্যাতনামা সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, তবে নিশ্চয়ই কমিশনার নির্বাচনের পথ অনেক সহজতর হয়ে উঠতে পারতো। কারণ, এই ধরনের ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ কমিশনের স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।

বর্তমান আইনের অধীনে কমিশনার হওয়ার জন্য যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচার ব্যবস্থায় বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে, অভিজ্ঞতার বিষয়টি শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রাসঙ্গিক দক্ষতা, জ্ঞান এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, কমিশনার নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের গুরুত্ব প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। ফলস্বরূপ, অনেক সময় শিক্ষা ও নৈতিকতার দিক থেকে অনুপযুক্ত ব্যক্তিরা কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হন, যা কমিশনের কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

এছাড়া, কমিশন যদি বাস্তব অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কাজ করতে চায়, তাহলে এই নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কিছু মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমত, কমিশনার নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের মধ্যে আরও গভীর ও ব্যাপক যাচাই-বাছাই করা উচিত, যাতে তারা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, কমিশন পরিচালনায় যে ধরনের নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করা হয়, তাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রভাব কমাতে হবে। এর জন্য, কমিশনের অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

তৃতীয়ত, কমিশনের কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য তথ্যের অ্যাক্সেস ও জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন। এতে জনগণের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে এবং কমিশনের প্রতি মানুষের সমর্থন বৃদ্ধি পাবে।

সবশেষে, কমিশনের কার্যকরী অবস্থান ও তার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। সরকার যদি নিশ্চিত করে যে দুদক একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে, তাহলে তা সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি দমনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এতে করে কমিশন সত্যিকার অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব পালনে সাফল্য অর্জন করতে পারবে।

মূলত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার প্রদান করতে হলে বিদ্যমান আইন সংস্কারসহ প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। যদি দুদককে সরকারের প্রভাবমুক্ত করা না যায়, তবে রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। তাই, এখনই সরকারের এবং আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত থেকে দুদককে উদ্ধারের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে।

দুদকের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, যেমন মানিলন্ডারিং আইন, কর আইন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে পূর্বানুমতির প্রয়োজনীয়তা। এসব বিষয় আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করলে কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আইনগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য সংঘর্ষ হলে, যে কোনো উদ্যোগ কার্যকর হবে না এবং এ কারণে দুদককে তার কাজের ক্ষেত্রে অকার্যকর করে দেওয়া হতে পারে।

দুদক, যা মূলত অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে, তা যেন সরকার কর্তৃক ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত না হয়, তার জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের জনসাধারণ অনেকদিন ধরেই এসব পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছে এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ বেড়েছে। এটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে দুদক আবারও দুর্নীতি দমনে সক্রিয় হয়েছে। তবে, যদি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতায় আসার পর দুদকের ভূমিকা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে।

গত মাসের শেষের দিকে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় ৫৫ দফার একটি প্রস্তাব প্রদান করেছে। এর মধ্যে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। টিআইবি-এর মূল আইনটির খসড়া প্রণয়নে যে ভূমিকা ছিল, সেহেতু দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানও এই বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত আছেন। তিনি যথাযথভাবে বুঝবেন কিভাবে দুদককে ‘নখ-দন্ত-থাবা’ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এটি একটি কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সুতরাং, আজকের সমাজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন দুদক প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে এবং যা জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ কেবল দুর্নীতি দমনে সহায়তা করবে না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জনগণের আস্থা অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
About Author Information

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন, একজন প্রজ্ঞাবান পেশাজীবী, যিনি গণিতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। তার আর্থিক খাতে যাত্রা তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকিং Inc. এবং ব্যাংক-আল-বিলাদে বিদেশী সম্পর্ক ও করেসপন্ডেন্ট মেইন্টেনেন্স অফিসার হিসেবে। প্রথাগত অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে, বিল্লাল একজন প্রখ্যাত লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে মননশীল কলাম ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। তার দক্ষতা বিস্তৃত বিষয় জুড়ে রয়েছে, যেমন অর্থনীতির জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, রেমিটেন্স, রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত দিক। বিল্লাল তার লেখায় একটি অনন্য বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে একত্রিত করে একাডেমিক কঠোরতার সাথে। তার প্রবন্ধগুলো শুধুমাত্র জটিল বিষয়গুলির উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন নয়, বরং পাঠকদের জন্য জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। বিল্লাল হোসেনের অবদান তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে, তিনি আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জটিলতাগুলি উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিস্তৃত এবং আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার দিকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

হাসিনার আমলে দাঁত-নখ-থাবা হারানো বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) কি স্বাধীন ও কার্যকর সংস্থা হিসাবে কাজ করে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে?   

Update Time : ০৯:২১:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের মহান উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হল সমাজের সর্বস্তরে একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার ঘটানো। কমিশনের আইন অনুযায়ী, এটি একটি স্বাধীন, স্বশাসিত ও নিরপেক্ষ সংস্থা হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কমিশন কতটুকু স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে যে ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, কয়েক মাস আগে তাকে দুদকের দায়ের করা মামলায় লোহার খাঁচার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, যা তার জন্য সর্বোচ্চ অসম্মানজনক ছিল।

দুদকের আইনজীবীরা যে মরিয়া হয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে লেগেছিল, তা অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে জানা নেই। সম্প্রতি, ৪ঠা সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও চার মামলার প্রস্তুতি ছিল দুদকে’ শিরোনামে সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগের মামলাটিও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসক্রিপশন পালনের অংশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকে দুদক ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, দুদক কী প্রতিক্রিয়া জানাবে? তারা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার বিষয়।  

এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করবে? কমিশনের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, অন্যথায় এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।

অপরাধ দমনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাকে যেন সরকার দাঁত-নখ-থাবা হারানো বাঘে পরিণত না করে, তার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে গোপাল হিসেবে সবকিছু দেখেছে। আকর্ষণীয় বিষয় হল, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুদক আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছে। সংস্কারের অভাব থাকলে ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে। গত মাসের শেষের দিকে দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টিআইবি ৫৫ দফার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে, যার মধ্যে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

সেনাসমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, দুর্নীতি দমন কমিশনে যোগদানের সময় তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দুদককে নখদন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, বাঘের নখ কেটে দেয়ার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা হ্রাসের প্রক্রিয়া চলছে। মেয়াদ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদায়কালে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনে ব্যর্থতার জন্য দুঃখ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একযুগ পর, মহামারি করোনাকালে ২০২১ সালে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করে বলে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে দন্তহীন বাঘের মতো আচরণ করা উচিত নয়। একই বছর, বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুদককে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, জনগণের আস্থা অর্জনে সেভাবে সফল হননি। যদি দুদকের চেয়ারম্যানরাই তাদের কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তাহলে এটি স্পষ্ট যে ‘ডালে কিছু কালো আছে’।

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, আন্দোলনকারী ছাত্রদের চাহিদার প্রতিফলন হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে নজর দিচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের সময়কালীন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়গুলো এখন গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ কাজে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান যদি সফলভাবে নখদন্তহীন দুদককে সংস্কার করতে পারেন, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কোথায় নিয়ে যেতে পারবেন এই প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে তাঁর হাত ধরে দুদকের কার্যক্রমে একটি নতুন দিক প্রবাহিত হওয়ার আশা করা যায়। এর মধ্যে, দুদকের বর্তমান কার্যক্রমের দিকনির্দেশনা কী, তা জানার আগে এর প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

দুদক প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি রোধ করা, কিন্তু এটি কার্যত অনেক সময় নখহীন বাঘের মতো হয়ে পড়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, যদি কমিশন যথাযথ সংস্কার না হয়, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। ড. ইফতেখারুজ্জামান যদি সংস্কারের মাধ্যমে কমিশনকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হন, তাহলে তা রাষ্ট্রের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তৈরি করবে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই উদ্যোগের ফলে জনগণের মধ্যে আশা জাগাতে পারে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং গণমানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওই সরকার দুর্নীতিবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তৎপর ছিল, যা সাধারণ মানুষের (যারা রাজনীতির বাইরে) একটি বড় অংশের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তখন দেড় শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয় এবং অনেককেই জেলে পাঠানো হয়।

এক-এগারোর পরিস্থিতিতে ড. ফখরুদ্দীন সরকারের সময়ে দুদক তার ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অজ্ঞাত কারণে দুদকের কার্যক্রম আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে। কমিশন তখন শুধুমাত্র চুনোপুঁটি ধরার উদ্দেশ্যে লোকদেখানো কাজে ব্যস্ত ছিল। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন সরকারের বড় ধরনের নেতারা দুদককে গুরুত্ব না দিয়ে ১৫টি বছর অতিক্রম করেছেন, যা প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ও জনগণের আস্থার জন্য একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন দুদক তার উদ্দেশ্য থেকে সরে গেল এবং কীভাবে এটি পুনরায় দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে? জনগণের কাছে দুদকের সঠিক ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি, নইলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

মোটামুটিভাবে বলা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করলেও অতীতের বিভিন্ন সরকার তাদের ইচ্ছেমাফিক প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদকের কার্যক্রমে বিগত সরকারের কোনো আড়ালে থাকা প্রভাব ছিল কি না। আসলে, দুদক কি সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে?

যদি দুদক আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণিত হয়, তবে এর পেছনে দায়ী কর্মকর্তা কে বা কারা? এত বড় প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক কর্মকর্তা নিশ্চয়ই রয়েছেন, যারা টিকে থাকার জন্য সরকারের ইশারা-ইঙ্গিতে কাজ করে থাকতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে, দুদকের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যদি কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ সরকারী চাপের মুখে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হন, তবে তা জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করবে এবং দুর্নীতি দমনে কমিশনের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং এর স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

সরকারের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর বজায় রাখা যায়, তা বোঝার জন্য কিছু দুর্বল আইন বা বিধি লক্ষ্য করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ক্রমিক নং ২৪-এ একদিকে বলা হয়েছে যে, “এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।” অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭-এর অষ্টম অধ্যায় উল্লেখ করেছে যে, “কমিশন ইহার নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে প্রেষণে অন্যত্র নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করিতে পারিবে, এবং সরকার উক্তরূপভাবে অনুরোধপ্রাপ্ত হলে উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে প্রেষণে নিয়োগ করিতে পারিবে।”

একই অধ্যায় আরও বলছে যে, “কমিশন ইহার দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের অধীন সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রেষণে নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করিতে পারিবে।” উপরোক্ত বিধিমালাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল যে, সরকার অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দুদকে পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে পারে এবং অপছন্দের ব্যক্তিদের সরিয়ে দিতে পারে।

এই কারণে, এ ধরনের বিধিমালা দুদকের ‘স্বাধীনতা’ শব্দের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হচ্ছে। যদি কমিশনের কার্যক্রমে সরকার প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়, তবে কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য, আইন ও বিধিগুলোর পুনর্বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে কমিশন সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) আইনে কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য যে বাছাই কমিটির উল্লেখ রয়েছে, সেখানে নিরপেক্ষ ও দক্ষ কমিশনার নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি সুগম নয়। বিশেষ করে, যদি এই বাছাই কমিটিতে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বা একটি নিরপেক্ষ ও খ্যাতনামা সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, তবে নিশ্চয়ই কমিশনার নির্বাচনের পথ অনেক সহজতর হয়ে উঠতে পারতো। কারণ, এই ধরনের ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ কমিশনের স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।

বর্তমান আইনের অধীনে কমিশনার হওয়ার জন্য যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচার ব্যবস্থায় বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে, অভিজ্ঞতার বিষয়টি শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রাসঙ্গিক দক্ষতা, জ্ঞান এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, কমিশনার নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের গুরুত্ব প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। ফলস্বরূপ, অনেক সময় শিক্ষা ও নৈতিকতার দিক থেকে অনুপযুক্ত ব্যক্তিরা কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হন, যা কমিশনের কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

এছাড়া, কমিশন যদি বাস্তব অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কাজ করতে চায়, তাহলে এই নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কিছু মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমত, কমিশনার নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের মধ্যে আরও গভীর ও ব্যাপক যাচাই-বাছাই করা উচিত, যাতে তারা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, কমিশন পরিচালনায় যে ধরনের নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করা হয়, তাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রভাব কমাতে হবে। এর জন্য, কমিশনের অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

তৃতীয়ত, কমিশনের কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য তথ্যের অ্যাক্সেস ও জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন। এতে জনগণের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে এবং কমিশনের প্রতি মানুষের সমর্থন বৃদ্ধি পাবে।

সবশেষে, কমিশনের কার্যকরী অবস্থান ও তার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। সরকার যদি নিশ্চিত করে যে দুদক একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে, তাহলে তা সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি দমনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এতে করে কমিশন সত্যিকার অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব পালনে সাফল্য অর্জন করতে পারবে।

মূলত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার প্রদান করতে হলে বিদ্যমান আইন সংস্কারসহ প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। যদি দুদককে সরকারের প্রভাবমুক্ত করা না যায়, তবে রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। তাই, এখনই সরকারের এবং আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত থেকে দুদককে উদ্ধারের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে।

দুদকের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, যেমন মানিলন্ডারিং আইন, কর আইন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে পূর্বানুমতির প্রয়োজনীয়তা। এসব বিষয় আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করলে কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আইনগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য সংঘর্ষ হলে, যে কোনো উদ্যোগ কার্যকর হবে না এবং এ কারণে দুদককে তার কাজের ক্ষেত্রে অকার্যকর করে দেওয়া হতে পারে।

দুদক, যা মূলত অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে, তা যেন সরকার কর্তৃক ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত না হয়, তার জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের জনসাধারণ অনেকদিন ধরেই এসব পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছে এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ বেড়েছে। এটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে দুদক আবারও দুর্নীতি দমনে সক্রিয় হয়েছে। তবে, যদি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতায় আসার পর দুদকের ভূমিকা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে।

গত মাসের শেষের দিকে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় ৫৫ দফার একটি প্রস্তাব প্রদান করেছে। এর মধ্যে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। টিআইবি-এর মূল আইনটির খসড়া প্রণয়নে যে ভূমিকা ছিল, সেহেতু দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানও এই বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত আছেন। তিনি যথাযথভাবে বুঝবেন কিভাবে দুদককে ‘নখ-দন্ত-থাবা’ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এটি একটি কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সুতরাং, আজকের সমাজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন দুদক প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে এবং যা জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ কেবল দুর্নীতি দমনে সহায়তা করবে না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জনগণের আস্থা অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।

শেয়ার করুনঃ
Pin Share