বাংলাদেশঃ কোন পথে রাষ্ট্র সংস্কার

- Update Time : ০৬:৪১:২৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৩৮৮ Time View

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, তবে সংস্কারের প্রকৃতি এবং তার বাস্তবায়নের পথে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। শাসনতন্ত্রের সংস্কারই বর্তমানে বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকবে না এবং যদি সংস্কার প্রক্রিয়া চলাকালে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে বর্তমানে বিদ্যমান ব্যাপক ঐকমত্য নষ্ট হতে পারে। তাই সংস্কার কার্যক্রম ত্বরিতভাবে সম্পন্ন করতে হবে এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের দ্বারা অকার্যকর করা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধার করে যতটা সম্ভব স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
সংস্কারের পথ কী হতে পারে
ছাত্র-জনতার এক বিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ অবস্থায়, এটি ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে অতীতের সরকারগুলোর তুলনায়, বর্তমান সরকার কিছু ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসন, কিংবা সংবিধানের স্থগিতকরণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাই, বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে বিচারিক পর্যালোচনায় নেতিবাচক সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা কম নয়। যদিও এই প্রশ্ন এখনো তেমন জোরালোভাবে উঠেনি, ভবিষ্যতে এটি উত্থিত হতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন, এবং তার মতামত হলো—যদি সংবিধান কার্যকর অবস্থায় ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না করা হয়, তাহলে সংবিধান কার্যকরে বাধা সৃষ্টির জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে হতে পারে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(খ) অনুযায়ী, মৌলিক বিধানগুলো ‘অসংশোধনযোগ্য’। অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার বিধানও রয়েছে। এটি নির্দেশ করে যে, সংবিধান প্রয়োগে কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় জরুরি অবস্থা বা কারফিউ জারির পরিস্থিতি ছিল না। ছাত্র-জনতার শক্তিই ছিল পরিবর্তনের মূল শক্তি। অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো একটি রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, সরকারের অস্থিরতার জন্য নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেছে, যেমন বিচারিক ক্যু, ব্যুরোক্র্যাসি ক্যু, পুলিশ বিদ্রোহ ইত্যাদি। এছাড়া, শেখ হাসিনার পদত্যাগের সম্ভাবনা এবং দিল্লিতে স্বৈরাচারকে রাখা ইত্যাদি উদ্বেগের বিষয়।
এ অবস্থায়, সরকারের কার্যকর বৈধতার জন্য কিছু পথ রয়েছে। একটির মধ্যে রয়েছে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ অনুসরণ করে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা। ‘ডকট্রিন অব কন্টিনিউইটি’ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সকল কার্যাবলি অবিরত চলতে থাকবে এবং সংবিধানের শূন্যতাও রাষ্ট্রের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না।
আরেকটি পথ হতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করা। সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম। অতীতে অচল সরকারের অবস্থা বিবেচনায়, রাষ্ট্রপতি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন। তবে, এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি হতে পারে বর্তমান রাষ্ট্রপতির অতীত রেকর্ডের কারণে।
তৃতীয় পথ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এ ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং বিশেষ জরুরি পরিস্থিতির বিবেচনায় বর্তমান সরকারের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। এতে রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে।
প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বেশি সময় লাগবে না, তবে বিচারিক পদক্ষেপ নিতে হলে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল যে ৯০ দিনের সময় উল্লেখ করেছেন, তাতে কিছুটা সময় বাকি আছে। এ সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যদিও এটি কিছুটা জটিল হতে পারে। বন্যা ও দুর্যোগের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের অভাব তৈরি হতে পারে, যা মোকাবিলা করা সহজ হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারে চারজন আইন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা এই বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ।
কোন কোন সংস্কার প্রয়োজন
সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো, পুলিশিং, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার। অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান সংবিধানের শুধুমাত্র সংশোধনের চেয়ে এর পুনর্লিখন করা জরুরি। বদিউল আলম মজুমদার ও কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে বিদ্যমান সংবিধানেই সংস্কার আনা সম্ভব।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, বর্তমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭(৩) ও ৫৮(৪) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিধান প্রদান করে। এই অনুচ্ছেদগুলো অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে গেলে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা নবনির্বাচিত সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবেন। যেহেতু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও অনেক মন্ত্রী ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং তারা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন, তাই বর্তমান সংবিধানের প্রতিটি বিধি পালন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন সুসংক্ষিপ্ত পথের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, আদালতের মাধ্যমে ২০১৪, ২০১৮, ও ২০২৪ সালের নির্বাচন ও সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করলে দ্রুত নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশে স্থায়ী গণতন্ত্র ও কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা গঠনের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি। এ জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে: ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মতো দলভিত্তিক আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, নেপালের মতো দলভিত্তিক ও সরাসরি ভোট পদ্ধতির সমন্বয়, দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও প্রাদেশিক ব্যবস্থার চালু, এবং আইনসভাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে এর নিয়ন্ত্রণে আনা।
বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা হলো জনগণের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অভাব। এ ব্যবস্থায়, ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৯০ শতাংশ আসন বা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১০ শতাংশ আসন পাওয়া সম্ভব। কিছু প্রার্থী নির্বাচিত হলে ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১০০ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধি হওয়ার পরিস্থিতি ঘটে। আনুপাতিক ব্যবস্থায়, জনগণ যে দলের প্রতি যত ভোট দেবে, সেই দলের প্রতিনিধিত্ব তার কাছাকাছি থাকবে। এর ফলে, অন্য দলের সহযোগিতা ছাড়া সরকার গঠন কঠিন হবে এবং কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ সঙ্কীর্ণ হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থা হলে, কেন্দ্রে এক দলের সরকার ও প্রদেশে অন্য দলের সরকার থাকতে পারে, যা ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা কঠিন করে তোলে।
মনে রাখার বিষয়সমূহ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, জনমত পরিবর্তনশীল এবং মানুষ দ্রুত অতীত ভুলে যায়। প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য মেয়াদকাল বাড়ানোর চেষ্টা সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে পারে। তাই, সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি একটি অভ্যুত্থান, যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং তার সরকারের দ্বারা জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ঘটেছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যে অংশগুলো সংবিধানে পরিবর্তন করেছেন, সেগুলো বাতিল করা উচিত। অন্যান্য সরকারের আমলেও মৌলিক অধিকার খর্ব করার যেসব সংশোধনী ও আইন প্রণীত হয়েছে, সেগুলোরও বাতিল করা প্রয়োজন। প্রথমত, আইনসভার শক্তি পুনর্গঠন করতে হবে এবং এটি করার জন্য আইনসভার সদস্যদের প্রকৃতভাবে নির্বাচিত হতে হবে। যদি কোনো সদস্য গুরুতর অসদাচরণ করেন, তাহলে তাদের অপসারণের বিধান থাকা উচিত। সরকারের তিনটি বিভাগে আইনসভাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হবেন।
ড. সলিমুল্লাহর সঙ্গে নীতিগতভাবে দ্বিমত করার সুযোগ নেই, কিন্তু নির্বাচনের পদ্ধতির সংস্কার না করলে অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না। নির্বাচিতরাও স্বৈরাচার হতে পারে, এবং এটি প্রতিরোধ করার জন্য কাঠামোর মধ্যে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা রয়েছে। তাদের উচিত জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা। জনগণের সমর্থন না পেলে এবং সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশের সাহায্য না পেলে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও রক্তপাত ঘটেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারত। ড. সলিমুল্লাহ সঠিকভাবে বলেছেন যে, দেশে নৈরাজ্য ও অধঃপতন থেকে রক্ষা পেতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত তাদের সংস্কার প্রক্রিয়ার সময়সীমা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধিকারভুক্ত নয় এমন সংস্কারে হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। বৈদেশিক সম্পর্কেও এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয় যা বৃহৎ পক্ষগুলোর বিরোধিতা তৈরি করে। এ ধরনের পদক্ষেপ সংস্কারের কার্যকারিতা বিপর্যস্ত করতে পারে। শেখ হাসিনার সরকার দিল্লির স্বার্থে দেশের সামগ্রিক প্রভাব হারিয়েছে, এবং বর্তমান সরকারের উচিত হবে না একপক্ষীয় হয়ে অন্যদের বিরোধিতা করা। ভারসাম্য ও সক্রিয়তা নিশ্চিত করতে পারলে, সরকার সফলভাবে অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হবে।
Please Share This Post in Your Social Media

বাংলাদেশঃ কোন পথে রাষ্ট্র সংস্কার


রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, তবে সংস্কারের প্রকৃতি এবং তার বাস্তবায়নের পথে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। শাসনতন্ত্রের সংস্কারই বর্তমানে বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকবে না এবং যদি সংস্কার প্রক্রিয়া চলাকালে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে বর্তমানে বিদ্যমান ব্যাপক ঐকমত্য নষ্ট হতে পারে। তাই সংস্কার কার্যক্রম ত্বরিতভাবে সম্পন্ন করতে হবে এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের দ্বারা অকার্যকর করা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধার করে যতটা সম্ভব স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
সংস্কারের পথ কী হতে পারে
ছাত্র-জনতার এক বিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ অবস্থায়, এটি ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে অতীতের সরকারগুলোর তুলনায়, বর্তমান সরকার কিছু ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসন, কিংবা সংবিধানের স্থগিতকরণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাই, বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে বিচারিক পর্যালোচনায় নেতিবাচক সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা কম নয়। যদিও এই প্রশ্ন এখনো তেমন জোরালোভাবে উঠেনি, ভবিষ্যতে এটি উত্থিত হতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন, এবং তার মতামত হলো—যদি সংবিধান কার্যকর অবস্থায় ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না করা হয়, তাহলে সংবিধান কার্যকরে বাধা সৃষ্টির জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে হতে পারে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(খ) অনুযায়ী, মৌলিক বিধানগুলো ‘অসংশোধনযোগ্য’। অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার বিধানও রয়েছে। এটি নির্দেশ করে যে, সংবিধান প্রয়োগে কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় জরুরি অবস্থা বা কারফিউ জারির পরিস্থিতি ছিল না। ছাত্র-জনতার শক্তিই ছিল পরিবর্তনের মূল শক্তি। অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো একটি রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, সরকারের অস্থিরতার জন্য নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেছে, যেমন বিচারিক ক্যু, ব্যুরোক্র্যাসি ক্যু, পুলিশ বিদ্রোহ ইত্যাদি। এছাড়া, শেখ হাসিনার পদত্যাগের সম্ভাবনা এবং দিল্লিতে স্বৈরাচারকে রাখা ইত্যাদি উদ্বেগের বিষয়।
এ অবস্থায়, সরকারের কার্যকর বৈধতার জন্য কিছু পথ রয়েছে। একটির মধ্যে রয়েছে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ অনুসরণ করে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা। ‘ডকট্রিন অব কন্টিনিউইটি’ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সকল কার্যাবলি অবিরত চলতে থাকবে এবং সংবিধানের শূন্যতাও রাষ্ট্রের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না।
আরেকটি পথ হতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করা। সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম। অতীতে অচল সরকারের অবস্থা বিবেচনায়, রাষ্ট্রপতি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন। তবে, এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি হতে পারে বর্তমান রাষ্ট্রপতির অতীত রেকর্ডের কারণে।
তৃতীয় পথ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এ ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং বিশেষ জরুরি পরিস্থিতির বিবেচনায় বর্তমান সরকারের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। এতে রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে।
প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বেশি সময় লাগবে না, তবে বিচারিক পদক্ষেপ নিতে হলে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল যে ৯০ দিনের সময় উল্লেখ করেছেন, তাতে কিছুটা সময় বাকি আছে। এ সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যদিও এটি কিছুটা জটিল হতে পারে। বন্যা ও দুর্যোগের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের অভাব তৈরি হতে পারে, যা মোকাবিলা করা সহজ হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারে চারজন আইন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা এই বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ।
কোন কোন সংস্কার প্রয়োজন
সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো, পুলিশিং, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার। অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান সংবিধানের শুধুমাত্র সংশোধনের চেয়ে এর পুনর্লিখন করা জরুরি। বদিউল আলম মজুমদার ও কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে বিদ্যমান সংবিধানেই সংস্কার আনা সম্ভব।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, বর্তমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭(৩) ও ৫৮(৪) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিধান প্রদান করে। এই অনুচ্ছেদগুলো অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে গেলে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা নবনির্বাচিত সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবেন। যেহেতু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও অনেক মন্ত্রী ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং তারা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন, তাই বর্তমান সংবিধানের প্রতিটি বিধি পালন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন সুসংক্ষিপ্ত পথের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, আদালতের মাধ্যমে ২০১৪, ২০১৮, ও ২০২৪ সালের নির্বাচন ও সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করলে দ্রুত নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশে স্থায়ী গণতন্ত্র ও কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা গঠনের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি। এ জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে: ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মতো দলভিত্তিক আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, নেপালের মতো দলভিত্তিক ও সরাসরি ভোট পদ্ধতির সমন্বয়, দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও প্রাদেশিক ব্যবস্থার চালু, এবং আইনসভাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে এর নিয়ন্ত্রণে আনা।
বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা হলো জনগণের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অভাব। এ ব্যবস্থায়, ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৯০ শতাংশ আসন বা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১০ শতাংশ আসন পাওয়া সম্ভব। কিছু প্রার্থী নির্বাচিত হলে ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১০০ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধি হওয়ার পরিস্থিতি ঘটে। আনুপাতিক ব্যবস্থায়, জনগণ যে দলের প্রতি যত ভোট দেবে, সেই দলের প্রতিনিধিত্ব তার কাছাকাছি থাকবে। এর ফলে, অন্য দলের সহযোগিতা ছাড়া সরকার গঠন কঠিন হবে এবং কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ সঙ্কীর্ণ হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থা হলে, কেন্দ্রে এক দলের সরকার ও প্রদেশে অন্য দলের সরকার থাকতে পারে, যা ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা কঠিন করে তোলে।
মনে রাখার বিষয়সমূহ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, জনমত পরিবর্তনশীল এবং মানুষ দ্রুত অতীত ভুলে যায়। প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য মেয়াদকাল বাড়ানোর চেষ্টা সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে পারে। তাই, সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি একটি অভ্যুত্থান, যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং তার সরকারের দ্বারা জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ঘটেছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যে অংশগুলো সংবিধানে পরিবর্তন করেছেন, সেগুলো বাতিল করা উচিত। অন্যান্য সরকারের আমলেও মৌলিক অধিকার খর্ব করার যেসব সংশোধনী ও আইন প্রণীত হয়েছে, সেগুলোরও বাতিল করা প্রয়োজন। প্রথমত, আইনসভার শক্তি পুনর্গঠন করতে হবে এবং এটি করার জন্য আইনসভার সদস্যদের প্রকৃতভাবে নির্বাচিত হতে হবে। যদি কোনো সদস্য গুরুতর অসদাচরণ করেন, তাহলে তাদের অপসারণের বিধান থাকা উচিত। সরকারের তিনটি বিভাগে আইনসভাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হবেন।
ড. সলিমুল্লাহর সঙ্গে নীতিগতভাবে দ্বিমত করার সুযোগ নেই, কিন্তু নির্বাচনের পদ্ধতির সংস্কার না করলে অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না। নির্বাচিতরাও স্বৈরাচার হতে পারে, এবং এটি প্রতিরোধ করার জন্য কাঠামোর মধ্যে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা রয়েছে। তাদের উচিত জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা। জনগণের সমর্থন না পেলে এবং সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশের সাহায্য না পেলে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও রক্তপাত ঘটেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারত। ড. সলিমুল্লাহ সঠিকভাবে বলেছেন যে, দেশে নৈরাজ্য ও অধঃপতন থেকে রক্ষা পেতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত তাদের সংস্কার প্রক্রিয়ার সময়সীমা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধিকারভুক্ত নয় এমন সংস্কারে হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। বৈদেশিক সম্পর্কেও এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয় যা বৃহৎ পক্ষগুলোর বিরোধিতা তৈরি করে। এ ধরনের পদক্ষেপ সংস্কারের কার্যকারিতা বিপর্যস্ত করতে পারে। শেখ হাসিনার সরকার দিল্লির স্বার্থে দেশের সামগ্রিক প্রভাব হারিয়েছে, এবং বর্তমান সরকারের উচিত হবে না একপক্ষীয় হয়ে অন্যদের বিরোধিতা করা। ভারসাম্য ও সক্রিয়তা নিশ্চিত করতে পারলে, সরকার সফলভাবে অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হবে।